চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হযরত দাউদ নবীর (আ.) জীবন ও শাসন

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৪ ডিসেম্বর, ২০২০ | ৩:০৬ অপরাহ্ণ

হযরত দাউদ (আ.) ছিলেন একজন মহান নবী ও বাদশাহ। সত্য ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করে এবং একটি ইনসাফপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠা করে তিনি অমর হয়ে আছেন। ইতিপূর্বে আমরা তাঁর ব্যাপারে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম।

হযরত দাউদ (আ.) তৎকালীণ জুলুমবাজ রাজা জালুতের বিশাল সশস্ত্র বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অলৌকিক শক্তি নিয়ে। নিরস্ত্র অবস্থায় মুখোমুখি হওয়ার জন্য দুর্ধর্ষ জালুত যখন দাউদকে পরিহাস করছিলেন, তখন দাউদ নবী আপন ঝুলিতে হাত দিয়ে একখানা পাথর বের করলেন এবং ফিঙ্গাতে পাক দিয়ে ঐ পলেস্টীয় বীর জালুতের কপালে আঘাত করলেন। আল্লাহর অশেষ কুদরতে পাথরখানা তার কপালে বসে গেল এবং সে ভূমিতে অধোমুখ হয়ে পড়ল। অত:পর দাউদ (আ.) দৌঁড়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালেন এবং স্বীয় খড়গ খুলে তাকে বধ করলেন।

অন্যান্য পলেস্টীয়রা যখন দেখল যে, তাদের মহাবীর নিহত হয়েছে তৎক্ষণাৎ তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেল। এ মহান বীরত্ব, সাহসিকতা ও পৌরুষত্বের বহিঃপ্রকাশে হযরত দাউদ (আ.) ইসরাঈলীদের মাঝে বিরাট সুনাম লাভ করেন। বাদশাহ তালুত তার ঘোষণা মোতাবেক স্বীয় কন্যাকে দাউদের (আ.) সাথে বিবাহ দেন, উপরন্তু তাঁকে মহান সম্মান ও সম্পদে ভূষিত করেন। এক পর্যায়ে তাঁকে স্বীয় পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সেনাধ্যক্ষের পদ দান করেন।

ইসরাঈলীদের এক বর্ণনায় এও বলা হয়েছে যে, শেষদিকে একসময় তালুত তাঁর উপর বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে পড়েন। কারণ স্থানীয়রা তার চেয়ে দাউদকেই বেশী শ্রদ্ধা ও সম্মান দান করতে থাকে। তালুতের এক সন্তানের নাম ইউতন। সে ছিল দাউদের বেশ ভক্ত। একদিন সে দাউদকে তাঁর বাবার অপরিচ্ছন্ন মন ও হিংসুটে আচরণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিল। ফলে, দাউদ তালুতের অধীনে রাজকর্তব্য পালন থেকে দূরে সরে যান। হযরত দাউদ (আ.) চেয়েছিলেন সত্য পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পাক এবং মিথ্যার ধ্বংশ ঘনিয়ে আসুক। তিনি ক্ষমতার জন্য লালায়িত নন, তিনি সেবা ও সংস্কারের সুযোগটাই শুধু কামনা করছিলেন। এরপর তালুতকে পলেস্টীয়দের সাথে আরো বেশ ক’টি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। এক যুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছিলেন। হযরত দাউদের (আ.) প্রতি ইসরাঈলীদের অত্যাধিক ভালবাসার কারণে তালুতের মৃত্যুর পর জাতি তাঁকে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। তিনি ইসরাঈল জাতির বাদশাহ নির্বাচিত হন। ক্ষমতা লাভের পর বনী ইসরাঈলীদের চারিত্রিক ও দ্বীনি সংশোধন ছাড়াও ইহলৌকিক কার্যাবলীর দিকনির্দেশনার দায়িত্বও নিজ স্কন্ধে তুলে নেন। আজকের সিরিয়া, ইরাকই ছিল তাঁর রাজ্য এবং তাঁর সম্রাজ্য আকাবা উপসাগর হতে পূর্বদিকে ফুরাত নদী এবং উত্তরে দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

এত শক্তি সামর্থ্য, বীরত্ব সাহসিকতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী হয়েও আজকের যুগের অন্য দশজন প্রতাপী শাসকের মত তাঁর ছিল না অহংকার, আমিত্ব, ছিল না বিলাসিতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, দাউদ নবীর শাসনব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য ছিল- আল্ল­াহর বান্দাদের সুখ-শান্তি, তাদের জানমালের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

জেরুজালেম ছিল তার রাজধানী। সঠিক বিচারব্যাবস্থা কায়েমের জন্য তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আদালত প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ লোকদের বিচারক আর আল্লাহভীরু আমানত লোকদের কোষাগারের রক্ষক নিয়োগ করেন। আল্লাহতায়ালা তাঁর রাজ্য শাসনের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেনঃ  ‘এবং আমি তাঁর রাজ্য সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাঁকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সুক্ষ্ম বিচারশক্তি প্রদান করেছিলাম।’ (সুরা সা’দ-২০)।  নবী ও রাসূলগণের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য হল বৈষয়িক ধন-দৌলতের প্রতি তাঁদের কোন আকর্ষণই থাকে না। তাঁরা কখনো ধন-সম্পদ সঞ্চয় করতেন না এটাকে ভালও জানতেন না। তথাপি তাঁরা মানুষ ছিলেন বিধায় একান্ত প্রয়োজনের তাগিদে যতটুকু সম্পদ দরকার ততটুকুর জন্যই তাঁরা যে কোন সৎপেশা গ্রহণ করতেন। সদাসর্বদা তাঁরা নিজেদের কষ্টে উপার্জন থেকে খেতেন এবং সৃষ্টিকুলের খিদমতে আঞ্জাম দিতেন। লোকদের থেকে তাঁরা কখনো নজর নিয়াজ এমনকি কোন বেতনও গ্রহণ করতেন না বরং যতটুকু পারতেন নিজেদের উপার্জন থেকে গরীব ও দুস্থদের সাহায্য দিতেন। তারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ ঘোষণাও দিতেন যে, আমরা ধর্মের প্রচার ও প্রসারের বিনিময়ে তোমাদের নিকট কিছু চাই না, আমাদের বিনিময় ও প্রতিদানতো একমাত্র মেহেরবান আল্লাহই দেবেন।’

বুখারী শরীফে ‘কিতাবুত তিজারাহ’ অধ্যায়ে হযরত দাউদ সম্পর্কিত একখানা হাদীস বর্ণিত আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ ‘মানুষের জন্য উত্তম জীবিকা হলো তা যা সে নিজ হাতে কষ্টের মাধ্যমে অর্জন করে। আর নিঃসন্দেহে দাউদ নবী নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।’ হযরত দাউদ (আ.) বিশাল সাম্রাজ্যের সম্র্রাট হওয়াতে ধন-ঐশ্বর্য তাঁর কম ছিল না। কিন্তু তিনি হুকুমতকে আল্লাহর আমানত বলে জানতেন এবং তা তিনি প্রজাদের কল্যাণেই শুধু ব্যয় করতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তিনি অর্থ গ্রহণ করা সমীচীন মনে করতেন না। তিনি সর্বদা খোদাতায়ালার দরবারে প্রার্থনা করতেনঃ হে আল্লাহ! এমন একটা উপায় আমার জন্য বের করে দাও যে, আমি নিজ হাতে যেন উপার্জন করতে পারি। আল্লাহপাক তাঁর দোয়া কবুল করেছেন এবং তাঁকে লোহা দ্বারা বর্ম বানানোর কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, আল্লাহতায়ালা তাঁর এ মহান নবীকে এমন একটি শক্তি দান করেছিলেন যে, তিনি কঠিন লোহা স্পর্শ করলে তা সুকোমল হয়ে যেত। আর তিনি তা ঢালাই করে সুন্দর সুন্দর হালকা বর্ম ও দেহবস্ত্র তৈরী করতেন। এসব সামগ্রী বিভিন্ন যুদ্ধে যেমন তাঁকে বিজয়মাল্য গ্রহণে সহায়তা করেছিল তেমনি ব্যবসায়িকভাবেও সফলতা এনে দিয়েছিল। কুরআনুল কারীমের সূরা সা’বার ১০ এবং ১১ ও সূরা আম্বিয়া’র ৮০ নং আয়াতে এ ব্যাপারে বর্ণনা এসেছে।

আজকের মানুষেরা মিথ্যা আভিজাত্যের দরুণ অলস ও কর্মবিমুখ, শাসকশ্রেণি অপচয় আর বিলাসিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। ফলে, কল্যাণ ও বরকতের পথ ক্রমেই রুদ্ধ হয়ে আসছে।

লেখক: মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট