চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

তাওহীদের প্রতি বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী’র (রহ.) দৃঢ়তা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৬ নভেম্বর, ২০২০ | ২:১১ অপরাহ্ণ

হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানীকে (রহ.) চেনে না বা তার নাম শোনেনি এমন মুসলমান বিশ্বে খুব কমই আছে। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান তার তরীকায়ে কাদেরীয়ার অনুসারী। এ রবিউসসানি মাসের ১১ তারিখ তার ওফাতদিবস। এজন্য এ দিন ফাতেহায়ে ইয়াজদাহম নামে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। হযরত বড় পীরের (রহ.) প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনার্থে এ ক্ষুদ্র লেখা। উল্লেখ্য, এ মহান বুজুর্গ ৪৭০ হিজরীতে জিলান শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

সায়্যিদুনা আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) থেকে প্রকাশিত কারামতের আধিক্য সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত। শায়খুল ইসলাম ইয়যুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম এবং  ইমাম তাইমিয়ার উক্তি- শায়খ (রহ.)-এর কারামত সংখ্যার গন্ডী ছড়িয়ে গিয়েছিল। তন্মধ্যে তার সর্বাপেক্ষা বড় কারামত হল মুর্দা দিলকে জীবিতকরণ। আল্লাহতায়ালা তার কলবের তাওয়াজ্জুহ ও মুখের তা’ছীরে লাখো মানুষকে ঈমানী যিন্দেগী দান করেছেন।

তার অস্তিত্ব ছিল ইসলামের জন্য বসন্ত সমীকরণের ন্যায় যা মৃত দিলের মাঝে নবতর প্রাণ-স্পন্দন সৃষ্টি করেছে এবং মুসলিম জাহানের ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার এক নতুন জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। শায়খ উমর কিসানী বলেন: শায়খের এমন কোন মজলিস বসত না যেখানে ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের কেউ না কেউ ইসলাম গ্রহণ না করত। ডাকাত, খুনী ও নানাবিধ পাপে লিপ্ত লোকেরা তওবার সৌভাগ্য লাভ করত এবং ভ্রান্ত আক্বিদা-বিশ্বাসের লোক তাদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস থেকে তওবা করত। (কালাঈদুল জাওয়াহির)।

হযরত শায়খ (রহ.)-এর ওয়াজ শ্রোতাদের অন্তরে বিদ্যুতের ন্যায় কাজ করত। তার কথায় আজো এ তা’ছীর বিদ্যমান। ফাতুহুল-গায়ব ও আল-ফাতুহুর রব্বানী- এর নিবন্ধ এবং তার মজলিসের ওয়াজের শব্দরাজি আজও মানুষের অন্তরকে উত্তপ্ত করে। দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হওয়া সত্বেও তার  কথামালার সজীবতা ও প্রাণস্পন্দন এখনো অটুট রয়েছে।

এক মজলিসে তাওহীদ ও আখলাক এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের তা’লিম তিনি এভাবে দেন তার উপরই নজর রাখো যিনি তোমার উপর নজর রাখেন। তার সামনেই থাকো যে তোমার সামনে থাকেন। তার সঙ্গে মহব্বত করো যিনি তোমাকে মহব্বত করেন। তার কথা মেনে চলো যিনি তোমাকে ডাকেন। নিজের হাত থাকেই দাও যিনি তোমাকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করবেন, মূর্খতার অন্ধকার থেকে টেনে বের করবেন, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবেন। ময়লা আবর্জনা ধুয়ে তোমাকে পচা-আবর্জনা, হীনতা-দীনতা এবং বদকার নফস ও পথভ্রষ্ট সাথী-সঙ্গীদের থেকে নাজাত দেবেন।

অপর এক মজলিসে তাওহীদ সম্পর্কে তিনি খোলাখুলিভাবে বলেনঃ গোটা সৃষ্টিজগত অক্ষম ও দুর্বল। কেউ তোমাকে লাভবান করতে পারে না, ক্ষতিগ্রস্তও করতে পারেনা। লাভক্ষতি সবকিছুই আল্লাহতায়ালা কোন না কোন সৃষ্টির হাত দিয়ে করিয়ে থাকেন। যা কিছু তোমার জন্য উপকারী অথবা অপকারী, আল্লাহর জ্ঞান মুতাবিক সে সব কিছুই তোমার ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে। এর অন্যথা হবার নয়। যারা তাওহীদবাদী এবং নেককার-তারা অবশিষ্ট সৃষ্টিজগতের উপর আল্লাহ নিদর্শন। এদের ভেতরে এমন আছেন কেউ কেউ যারা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয়ই দিক দিয়ে দুনিয়া থেকে অনাবৃত উন্মুক্ত, যদিও তারা ধনাঢ্য। এই কলব যার পরিস্কার, যে ব্যক্তি একে করায়ত্ত্ব করতে পেরেছ, গোটা সৃষ্টিজগতের সে বাদশাহী পেয়ে গেছে। (ফুযূয়ে ইয়াজদানী)।

হযরত শায়খ (রহ.) সেই সব ‘দরবারী ও সরকারী’ আলিম-উলামা এবং মাশায়েখদেরকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন এবং নির্ভিকভাবে তাদের স্বরূপও উদঘাটন করতেন, যারা তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতি ছেড়ে ক্ষমতাসীনদের মোসাহেবী অবলম্বন করেছিল এবং ওদের সুরে সুর মিলানো যাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল, যাদের কারণেই আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে ঐসব সুলতান ও শাসকদের দুঃসাহস আরো বেড়ে গিয়েছিল। একবার একশ্রেণীর লোকদের সম্বোধন করতে গিয়ে বলেনঃ ওহে ‘ইলম ও আমল খেয়ানতকারী ব্যক্তিগণ! তোমাদের সাথে কি সম্পর্ক? ওহে আল্লাহ ও তার রাসুলের দুশমন দল! ওহে আল্লাহর বান্দাদের লুণ্ঠনকারী দুর্বৃত্তের দল, তোমরা প্রকাশ্যে জুলুম ও মুনাফিকীতে লিপ্ত রয়েছ। তোমাদের এই মুনাফিকী আর কতদিন থাকবে? ওহে আলিমগণ! ওহে বুজুর্গের দল। আর কতদিন তোমরা মুনাফিকী করে বাদশাহ ও সুলতানদের পার্থিব অর্থ-বিত্ত-ধন-সম্পদ এবং তাদের স্ফূর্তি ও কামনা-বাসনার সঙ্গী হয়ে থাকবে? তার এসব প্রভাবমন্ডিত ও বিপ্লবাতœক ওয়াজ দ্বারা বাগদাদবাসীদের বিরাট আধ্যাত্মিক (রূহানী)। নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণ সাধিত হয় এবং হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জিন্দেগীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে বটে।

হযরত শায়খ (রহ.)- এর অস্তিত্ব ছিল সেই বস্তুবাদী যুগে ইসলামের একটি জীবন্ত মু’যিজা এবং এক বিরাট গায়বী মদদ। তার ব্যক্তিসত্ত্বা, তার কামালিয়াত, তার প্রভাব আল্লাহপাকের দরবারে তার মকবুল বান্দা হিসেবে গৃহিত হবার চিহ্নাদি, আল্লাহর মাখলুকাতের মধ্যে তার মাহাত্ম্য ও সম্মানজনক মর্যদার স্বীকৃতি, তার ছাত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাথীদের নৈতিক চরিত্র এবং তাদের জীবন ও চরিত্র সবই ইসলামের সত্যতার দলিল এবং তার জীবন্ত কামালিয়াতের প্রমাণ। (রেনেসার অগ্রপথিক-১)।

দীর্ঘকালব্যাপী বিশ্বকে স্বীয় জাহেরী ও বাতেনী কামালিয়াত দ্বারা উপকৃত করে এবং মুসলিম জাহানে আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর দিকে ফিরে যাবার বিশ্বজয়ী আনন্দ, সুখ ও স্বাদ সৃষ্টি করে তিনি ৫৬১ হিজরীতে ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার পুত্র হযরত শরফুদ্দীন ঈসা (রহ.)-এর ওফাতের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: যখন তিনি সেই রোগে আক্রান্ত হন যে রোগে শেষাবধি তার ইন্তেকাল হয়েছিল তখন সাহিবজাদা শায়খ আবদুল ওয়াহহাব তাকে (শায়খকে) আরজ করেন: আপনি আমাকে কিছু ওসিয়্যত করুন যা আপনার পরে আমি আমল করতে পারি।

তিনি বললেন: আল্লাহকে সদা-সর্বদা ভয় করতে থাকবে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। তিনি ভিন্ন আর কারো কাছে কোন কিছু প্রত্যশা করবে না। নিজের যাবতীয় প্রয়োজন আল্লাহর হাতে সমর্পন করবে, কেবল র্তাধসঢ়;ই ভরসা রাখবে। সব কিছু তার নিকটই চাইবে, আল্লাহ ভিন্ন আর কারোর উপর আস্তা রাখবে না। তাওহীদকে দৃঢ়ভাবে আকঁড়ে ধরবে এবং তাকেই প্রধান অবলম্বন করবে। কেননা, তাওহীদের বিষয়ে কারো কোন মতভেদ নেই, বরং এতে সবার ঐক্যমত্য রয়েছে। তিনি আরো বলেন: যখন মানুষের দিল আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন কোন জিনিসই তার থেকে ছুটে যায় না। হযরত শায়খ (রহ.) এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। কিন্তু পশ্চাতে ছেড়ে যান দ্বীন (ইসলাম)- এর বিরাট আহবায়ক (দা’ঈ) দল এবং নফস ও আখলাকের মুরব্বীদের একটি সংঘবদ্ধ জামাআত, যারা তার মিশনকে অব্যহত রাখেন এবং অগ্রসরমান বস্তুবাদের মোকাবিলা করতে থাকেন।

আমাদের প্রাত্যাহিক ইবাদত বন্দেগীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য, আখিরাতের ভয়কে সদা জাগারুক রাখার জন্য সর্বোপরি মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার রেজামন্দি হাসিলের জন্য হযরত বড়পীরের (রহ.) বিশাল জীবন ও কর্মসাধনা আমাদের  অনুপ্রেরণার উৎস। তাই আমরা তাকে স্মরণ করি, তার উপদেশ ও শিক্ষা আমল করি, তার প্রকৃত অনুসারীদের সুুসংগঠিত উত্থান কামনা করি।

লেখক: মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট