২১ নভেম্বর, ২০২০ | ২:২১ অপরাহ্ণ
ড. চৌধুরী মোহাম্মদ মনিরুল হাসান
মধ্যচীনের উহান শহর থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া SARS-COV2 নামের নভেল করোনা ভাইরাসটি বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত, সবখানেই মহামারীতে (Pandemic) রূপ নিয়েছে। এই ভাইরাসের কারণে বিশ্বের তাবৎ মানুষকে এখন এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, যার অভিজ্ঞতা বোধহয় বিগত কোনো সময়ে মানুষের সম্মুখে আসেনি।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ব্যস্ত শহরগুলোতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারের মতো লকডাউন, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে খুবই সীমিত যাতায়াত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ যদিও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনের মাধ্যমে তাদের শিক্ষার্থীদের কিছুটা মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছে ও পড়ালেখার কার্যক্রমে সম্পৃক্ত রাখছে। প্রায় সব ধরনের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পূর্ণ উদ্যমে চালু হতে পারেনি। এখন সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বারের মতো (Second wave) ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। এতে প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখের উপরে এবং সুস্থ হয়েছে প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ এবং তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৩ লাখের বেশি মানুষ। পাশাপাশি আমাদের বাংলাদেশও দ্বিতীয় সংক্রমণ (Second wave) শুরু হয়ে গেছে এবং আমাদের সাড়ে চার লাখ লোক এই প্রাণঘাতী ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে সুস্থ হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ এবং মৃত্যু হয়েছে ছয় হাজারের অধিক। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে এই পর্যন্ত যারা বাসায় আছেন এবং চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে ফলোআপে আছেন, নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হওয়ার জন্য সময় নিচ্ছেন তাদেরকে নিয়ে আজকে আমার দুটি কথা বা পরামর্শ। কোভিড পরবর্তী রোগীর জটিলতা, যত্ন, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাত্রা, ওষুধপত্র, খাওয়া-দাওয়া এই সবগুলোকে একসাথে আমরা পোস্ট কোভিড ম্যানেজমেন্ট বলি (Post Covid Management)।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল এই সময়টা খুব গুরুত্ব দিয়ে চলতে হবে। কারণ এই নভেল করোনাভাইরাসটি ইতোপূর্বে কোন মানুষকে আক্রান্ত করেনি বা কোন বিজ্ঞানী বা অন্য কারো কাছে এই ভাইরাসের অতীত কোন ইতিহাস নেই। সেজন্য এই ভাইরাসের চরিত্র সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। এই ভাইরাস পরবর্তীতে আমাদের শরীরের কোন অঙ্গকে আবার আক্রান্ত করবে কি না কিংবা এই ফ্লু ভাইরাস থেকে কিভাবে পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়া যায় ইত্যাদি। যদিও এই রোগ থেকে পরিপূর্ণ সুস্থ হতে আমাদের হলিস্টিক এপ্রোচ বা সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি সম্প্রতি করোনা সংক্রমিত হয়েছিলাম এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে করোনামুক্ত হয়েছি। তাই আমার কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধি, জ্ঞান ও কিছু পরামর্শ, যেগুলো ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক সাময়িকী কর্তৃক স্বীকৃত।
যাদের শ্বাস কষ্ট (COPD), হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি ডিজিজ পূর্ব থেকে আছে তাদেরকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদেরকে অবশ্যই একজন মেডিসিন অথবা বক্ষব্যধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই রোগ থেকে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হতে একজন মানুষের বিভিন্ন বয়স অনুযায়ী দুই থেকে ছয় মাসও লেগে যেতে পারে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রতিদিন ওষুধ সেবন করতে হবে এবং শরীরের তাপমাত্রা, ব্লাড প্রেসার, পালস এবং অক্সিজেন সেচুরেশন, রক্তে শর্করার পরিমাণ ইত্যাদি খেয়াল রাখতে হবে।
যদি গলাব্যথা, কফ, সর্দি ইত্যাদি আবার ও দেখা যায় তাহলে আমাদেরকে লবণ পানি দিয়ে গারগল করতে হবে ও গরম পানির ভাপ নিতে হবে। খাদ্যতালিকা করে, রুটিন মাফিক সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য এবং বিশেষ করে অধিক প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন: ডিম, দুধ, গোশত, চিকেন স্পু, সামুদ্রিক মাছ, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম ইত্যাদি বেশি বেশি করে খেতে হবে। ভিটামিন সি জাতীয় ফল ও জুস অবশ্যই খেতে হবে। শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি বেশি বেশি করে খেতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে। যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো খাওয়ার সময় সঠিকভাবে সোজা হয়ে বসে, মনোযোগ সহকারে খেতে হবে। ছোট-বড়, শক্ত-নরম সব ধরনের খাদ্য খেতে হবে এবং কিছুক্ষণ পরপর খেতে হবে, যাতে করে শরীর দুর্বল না হয়। ধূমপান ও এলকোহল পরিত্যাগ করতে হবে এবং নিয়মমাফিক কিছু হালকা ব্যায়াম করতে হবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যায়াম যেটাকে আমরা বলি মেমোরি ওয়ার্ক। যেহেতু এই ভাইরাসটি মানুষকে স্মৃতিশক্তি ও কমিয়ে দিতে পারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। তাই স্মৃতিশক্তিকে ধরে রাখার জন্য কিছু গেম আছে, যেমন: মেমোরি গেম, পাজলস, দাবাখেলা, কোন গল্প কিংবা পুরানো স্মৃতি বলা ইত্যাদি আমরা অনুশীলন করতে পারি।
শরীরের প্রতি নজর রাখবেন যাতে কোনো ধরনের রক্তপাত, মাথাব্যাথা, অবসাদ লাগা অথবা শরীরের মধ্যে কোন ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া। এগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। কয়েক সপ্তাহ পর পর অথবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু বায়োকেমিক্যাল টেস্ট, যেমন: লিপিড প্রোফাইল, সুগার টেস্ট, HbA1C, CRP , ইলেক্ট্রোলাইটস, X-ray, সিটি স্ক্যান করে দেখতে হবে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের অবস্থা কেমন। সর্বোপরি নিজেকে একটু সময় দিন আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিন রেজাল্ট নেগেটিভ হওয়া অথবা একটু একটু ভাল লাগা মাত্র পুরোদমে কাজে যোগ দেবেন না। একটু সময় নিয়ে আস্তে আস্তে কাজ শুরু করবেন। সর্বোপরি অন্যের সাথে আপনার এক্সপেরিয়েন্স বা অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করুন এবং তাকেও কিছু উপদেশ দিন। তাতে আপনার ভালো লাগবে এবং আপনার পরিপূর্ণ সুস্থ্য হতে সহায়ক হবে।
সাধারণ জনগণ যারা এখনো করোনা আক্রান্ত হননি তাদের জন্য 3Cs (Crowded Places, Close Contact, Confined and enclosed spaces ) ফর্মুলা মানতে হবে। প্রথমত: তাদেরকে আবদ্ধ জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ, যেখানে আলো-বাতাস ইত্যাদি কম চলাচল করে, দ্বিতীয়ত: কোলাহলপূর্ণ জায়গা যেখানে অনেক লোকজন চলাচল করে, যেমন হাট বাজার। তৃতীয়তঃ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার ইত্যাদি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস আমাদের গড়ে তুলতে হবে সেটি হচ্ছে যে মাস্ক (Mask) পরা। আমি সেক্ষেত্রে বলবো ভালো মানের মাস্ক যেটিকে ধুয়ে কয়েকবার পরা যায় অথবা তিন স্তরবিশিষ্ট কাপড়ের মাস্ক পরা। সবার জন্য মাস্ক পরা জরুরী। কারণ মাস্ক পরলে নিজেও বাঁচবেন অপরকে বাঁচাবেন। পরিশেষে মেডিটেশন, হালকা ব্যায়াম এবং দৈনিক ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস তৈরি করা খুবই জরুরী। ধর্মীয় বই, সংগীত কিংবা সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে আপডেটেড থাকুন। সৃষ্টিকর্তা উপর অগাধ বিশ্বাস রাখুন।
লেখক: ড. চৌধুরী মোহাম্মদ মনিরুল হাসান অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্বকোণ/এএ
The Post Viewed By: 273 People