চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মহানবীর (স.) সামাজিক ভ্রাতৃত্ব

মহানবীর (স.) সামাজিক ভ্রাতৃত্ব

মনিরুল ইসলাম রফিক

১২ নভেম্বর, ২০২০ | ২:০৯ অপরাহ্ণ

গত সপ্তাহে আমরা এ কলামে সামাজিক পুনর্বাসনে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মুয়াখাত বা ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কল্যাণকর দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ এ প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি। এখন সমাজে মানুষ যেভাবে স্বার্থান্ধ হয়ে অন্যকে দূরে ঠেলে দেয়ার মানসিকতা দেখাচ্ছে, একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া সে কোন কিছু শুনতে নারাজ। এ অবস্থায় মহানবী (স.) এর শিক্ষা ও আদর্শে বিশেষ করে ইসলামের দেয়া মুয়াখাত ধারণায় উজ্জীবিত হওয়া গেলে তা অনেকটা প্রশমিত হয়ে আসতো।

কিসে নিজের মর্যাদা বাড়ে তা মানুষ ভুলে বসেছে, অন্যের সাথে তারা কি ধরণের সম্পর্ক বজায় থাকা চাই তা খুব থোড়াই ভাববার অবকাশ পায় সে। অথচ সত্যিকার আদর্শিক মানুষ কখনো একা চলতে পারে না, শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে না। তামাম দুনিয়ায় সুখ-দুঃখের বন্ধনে আমরা পরস্পর সহযোগী। কুরআনুল করীমে ইরশাদ হয়েছে; মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (৪৮ ঃ১০)।

মহানবী (স.) প্রবর্তিত মদীনার ঐশী সমাজের অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য ছিল পরস্পরের মধ্যে দ্বীনি ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধন। কোন আদর্শিক সমাজে এ ত্যাগী বন্ধন অপরিহার্য একটি সামাজিক অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নচেৎ সমাজকে নীরব শোষণ ও দ্বেষ-ক্লেশ মনোভাব থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। এদিকটির কথা বিবেচনায় এনেই ইসলামের হুকুম আহকাম, বিধি বিধানগুলো প্রতিনিয়ত বারে বারে উম্মাহর শিক্ষা ও দর্শনের দিকে ধাবিত করা হয়েছে। যেমন কালেমায়ে তাইয়্যেবার মাধ্যমে ইসলাম চায় মানুষের সমুদয় প্রভুত্ব, বিভেদ দূরীভূত করতে, অভিন্ন চিন্তা চেতনা মনমানসিকতা ও আদর্শগত আভিজাত্যে উজ্জীবিত করতে। জামায়াতে নামাজ আদায়ের তাগিদ দেয়ার মাধ্যমে ইসলাম চায় সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর মানুষকে একই কাতারে শামীল করতে এবং পারস্পরিক সুবিধা অসুবিধাসমূহ সহমর্মি ভাইবোনদের কাছে প্রকাশ করতে। রোজার মাসে রাখা হয়েছে সম্মিলিত দহন ও সহন অনুভব অনুভূতি সৃষ্টি করতে, ইফতারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সময়ের গুরুত্ব ও অন্যকে কাছে টানার শিক্ষায় উজ্জীবিত এবং সবশেষে পবিত্র হজে¦র আনুষ্ঠানিকতার মাঝে নিহিত রাখা হয়েছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, বিশ্ব মানবাধিকারের শিক্ষা, বিশ্ব শান্তির শিক্ষা সর্বপরি পরকালীন পোশাকে নিষ্পাপ জীবন ধারনের অনুশীলন ও শপথ। পবিত্র হজ¦ আদায়ের জন্য সমবেত হল একাকার হয়ে যায় বিশ্বের শত কোটি তাওহীদবাদী মুসলমান। মুছে যায় ভাষা ও বর্ণের সব ব্যবধান। স্ব স্ব জাতীয় পোশাক ও পরিচয় এতো দিন যা ছিল তাদের একান্ত গর্বের, একান্ত আপনার ত্যাগ করে হাজীরা অঙ্গে ধারণ করে ইহরাম নামের শ্বেত-শুভ্র একক ইসলামী জাতীয় পোশাক। এখানে আমীর- গরীব ও বান্দা মনিবের কোন তফাৎ থাকে না, নেই ছোট বড় কোন ভেদাভেদ, লক্ষ কণ্ঠের ভাবগম্ভীর ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে সব কিছু চাপিয়ে ভেসে উঠে সার্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মনোমুগ্ধ দর্শন।

১০ম হিজরীতে এমনি একটি প্রতীকী হজে¦র মৌসুমে আরাফাত ময়দানের বাতনে ওয়াদী নামক স্থানে কাসওয়ার পিঠে দাঁড়িয়ে সফল মহাসংস্কারক হুজুরে আকরাম (স.) ঘোষণা করেছিলেন : সাবধান হে মানুষেরা তোমাদের পিতা এক, তোমরা এক আদমের সন্তান, আর আদম (আ.) মাটি থেকে সৃষ্ট। নিশ্চয় প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের ভাই আর সকল মুসলমানরা এক অখন্ড ভ্রাতৃ সমাজ।’ (ভাষণের অংশ বিশেষ)।

বস্তুত পক্ষে মহানবীর (স.) এ নির্দেশনামা তাঁর সাহাবায়ে কেরাম পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে অনুসরণ করেছেন। শুনলে বাস্তবিকই বিস্ময় লাগে, ভ্রাতৃ সম্বন্ধের উপর নির্ভর করে মদীনার আনসারগণ নিজেদের জমিজমা, ধন-দৌলত ও ঘরবাড়ি সমস্তই নতুন ভাইদের উদ্দেশ্যে বণ্টন করেছিলেন। মুহাজিরগণ কৃষিকর্ম জানতেন না বলে আনসারগণ নিজেরাই তাদের অংশের জমিজমা চাষবাস করে ফসল উৎপন্ন করে দিতেন, মুহাজিরগণ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে যা উপার্জন করতেন তারও ন্যায্য অংশ দিতে লাগলেন তাদের মাদানী আনসার ভাইদের। কারো মৃত্যু ঘটলে তার ‘ধর্ম ভাই’ রীতিমত হিস্যা পেতে লাগলেন। (বিশ্বনবী : ১৯০)। অথচ আজকাল নিজ ভাইগণের মাঝে সুষ্ঠু মন মানসিকতার অভাবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিরোধের অন্ত নেই। জমি জমা নিয়ে হাঙ্গামা তো লেগেই আছে।

উল্লেখ্য, আনসার-মুহাজির সমস্যা যে মক্কা মদীনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। মানব গোষ্ঠীর এ এক চিরন্তন সমস্যা। যুগে যুগে প্রত্যেক জাতিই এরূপ সমস্যার সম্মুখীন হয়। রাজনৈতিক বিপ্লবের ফলে এক দেশের অধিবাসী আরেক দেশের স্বজাতীয় ভাইদের শরণ নিতে বাধ্য হয়। আনসার-মুহাজির সমস্যা তখনই জেগে উঠে। পাকিস্তানে এ সমস্যা আজ অর্ধশত বছরেও সুরাহা হয়নি।

এখনো মাঝে মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক দাঙ্গাহাঙ্গামার সূত্রপাত হয়ে থাকে। আনসার ও ধনিক শ্রেণীর উচিৎ মুহাজির ও গরীব শ্রেণীর দুর্দিনে তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা এবং মুহাজির অভাবীদের উচিৎ আনসারদের সুখ দুঃখের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয়া। কোন একটা নতুন দেশ, নতুন সমাজের নাগরিক অধিকার লাভ করার পর উভয়ের স্বাতন্ত্র্য লোপ করে দেয়া বাঞ্চনীয়। এতে সমাজের শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধি পায়। পুনর্বাসন সমস্যা হয় সহজতর। আজকের সমাজ সুন্দরে এ চিন্তা ও দর্শন অতীব প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

আমরা বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ছোটদের  স্নেহ মমতা বিতরণ করে দেশে বিদেশে সহমর্মিতার পয়গাম প্রচার করতঃ ইসলামি বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বহির্প্রকাশ ঘটাতে পারি।

লেখক: মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট