চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিল্পী মনসুর-উল-করিম স্মরণ

কাদামাটির সন্তান রঙিন ক্যানভাসে

এজাজ ইউসুফী

৬ নভেম্বর, ২০২০ | ২:৩৫ অপরাহ্ণ

শিল্পী মনসুর-উল-করিম-এর সঙ্গে কোনোকালেই আমার তেমন জানাশোনা কিংবা সখ্য ছিল না। কিন্তু ফেসবুক বন্ধু হওয়ার পর থেকে যেন আমাদের মধ্যে এক দূর-বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন তৈরি হয়। প্রতিদিন ‘শুভ সকাল’ দিয়ে শুরু করতেন। তারপর সারাদিন ক্রমাগত তাঁর মেসেজ আসতো আমার ম্যাসেঞ্জারে। কোনো কাজে মনোনিবেশ করেছি তখনই তাঁর মেসেজ। হয়তো তাঁর কোনো চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য কিংবা মোবাইলে তোলা প্রকৃতির নানান দৃশ্য কিংবা ভিডিও। মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু আজকে তাঁর এই ম্যাসেজগুলো দেখে-পড়ে সত্যিই চোখে জল এসে যায়। তিনি ঠাণ্ডু করিম নামে কবিতা লিখতেন। সেগুলো ম্যাসেঞ্জারেই আমাকে পাঠাতেন। একজন চিত্রশিল্পীর কবিতা আমায় তেমন না টানলেও আজ মনে হয় এগুলো বেশ মূল্যবান। কারণ, এখানে তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনের কথা, প্রকৃতির কথা, চেনা-মানুষদের কথা আছে। সবচেয়ে বড়কথা তাঁর হতেগড়া ‘বুনন আর্ট স্পেস’- কে ঘিরে তাঁর কিছু স্বপ্নের কথা জানাতেন। লিখে কিংবা ছবি তুলে। সে সব কিছু সংক্ষেপে তুলে ধরার আগে শিল্পী মনসুর-উল-করিমের জীবন-কর্ম সম্পর্কে কিছু লেখা আবশ্যিক।

একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী মনসুর-উল-করিম রাজবাড়ী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে চারুকলায় স্নাতক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। তিনি দীর্ঘ ৪০বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রামে প্রদর্শনী করেন। জীবৎকালে তাঁর ২৬টি প্রদর্শনী হয়েছে দেশে-বিদেশে। মূলত ’৬০-এর দশকে শিল্পী হিসেবে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। এরপর একের পর এক চিত্রপ্রদর্শনী করে গেছেন।

শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর এক শিক্ষার্থী একটি দৈনিকে তার শিক্ষক সম্পর্কে লিখেছেন “বাণিজ্যিক শিল্পকলাকে কীভাবে জনশিল্পে পরিণত করতে হয়, তার হাতেখড়ি আমার হয়েছে মনসুর-উল-করিমের কাছে, যা পরবর্তী সময়ে আমার আয়-রোজগারে সহায়ক হয়েছিল।” আমরা সকলেই জানি, যারা চারুকলা থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হন, তাদের অধিকাংশ না হন শিল্পী, না পান একটি চাকুরির নিশ্চয়তা। সুতরাং জীবন-নির্বাহের জন্য তাদেরকে হয় ক্রাফটম্যান; না হয় অন্য কোনো পেশায় ঢুকে পড়তে হয়। মনসুর-উল-করিম তাঁর ছাত্রদের এই বেদনাকে অনুভব করেছিলেন। তাই তাদের সেইভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। অবসরে যাওয়ার পর তিনি সুবিধাবঞ্চিত চারুকলায় আগ্রহী শিল্পীদের জন্য তাঁর গ্রামের রাজবাড়ীতে ‘বুনন আর্ট স্পেস’ গড়ে তুলেছিলেন। এটি রাজবাড়ীর রামাকান্তপুর স্বর্ণশিমুল গ্রামে অবস্থিত। যেখানে চারিদিকে প্রকৃতি ও নির্জনতার ছড়াছড়ি।

আমি চিত্রকলার তেমন কিছু বুঝি না। তবে, অনুভব করতে পারি কবির মন নিয়ে। তাঁর চিত্রকর্মগুলো দেখে মনে হয় শিল্পী ক্যানভাসের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছেন গণমানুষের স্ট্রাগল। ভীষণ নিরীক্ষা-প্রবণ এই শিল্পীর একটি ছবির সামনে দাঁড়ালেই বলে দেয়া যায়, এটি মনসুর-উল-করিমের আঁকা। কারণ, তাঁর ক্যানভাসের উজ্জ্বল রঙ, গণমানুষের ফিগার, নারীর সুঠাম অবয়ব, পদ্মানদীর চারপাশ ঘিরে তাঁর দেখা স্মৃতিময় দৃশ্যবলী, মাছধরা, মেঘমালার উড্ডয়ন, বৃষ্টির অপূর্ব ব্যঞ্জনা, জলোচ্ছ্বাস, সোনালি ফসলের সোনারঙ, কৃষক আর কৃষাণীর চলচ্ছবি, প্রতিকূল পরিবেশ, নাম না জানা কোনো বুনোফুল, জলাশয়, জীব-বৈচিত্রের নানান আকৃতি, পরিবেশ, পাহাড়, নদী, গাছপালার সমারোহ যেন প্রকৃত বাংলার রূপকে উদ্ভাসিত করে।

শিল্পী মনসুর-উল-করিম আমাকে শুভ সকাল জানাতেন তাঁর একটি পেইন্টিং-এর ছবি দিয়ে। জুনের ২৬ তারিখ ভোর ৪.৪২-টায় একটি ছবি দিয়েছিলেন! একটি ঝাড়গাছ। গোড়াটি শুকনো। তার মাঝের অংশ আলো পড়ে গেরুয়া রঙ ধারণ করেছে। ছবির নিচে ধবধবে ছোট্ট একটি স্ট্যাচু। নারী-পুরুষের মিলন! ২৯জুন ভোর ৪.২৪-টায় দিলেন ‘রাজবাড়ীর টেপা ঘোড়া’ (সংগৃহিত ছবি), ৪ জুলাই দিলেন একটি ভিডিও ‘আজ সকালে!!!!!!! আমি।’ সাতটি আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়ে! এভাবে ‘প্রথম আলো, আজ সকালে দাওয়ায় আমার’, ‘চাঁদের আলোর বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো’ (ভিডিও), ‘ক্ষণে সন্ধ্যা’ (সেলফি), ‘খোলা জানালা’ (তেলরঙ), ‘সন্ধ্যা নামে আজি’ (ফটোগ্রাফি), ‘বৃৃষ্টিস্নাত আমার উঠোন’ (ভিডিও), ‘দেখরে নয়ন মেলে জগতের বাহার দিনের আলোয়, দিনের আলোয় কাটে অন্ধকার’ (ভিডিও), ‘আমি যখন আমার মাঝে’ (নিজের ভিডিও)। এগুলো সবগুলো জুলাই মাসে পাঠানো। তিনি প্রতিদিন এতো এতো ছবি, পেইন্টিং ও ভিডিও পাঠাতেন যে, তার আগেরগুলো আমি ডিলিট করে দিই।

শিল্পী জুলাই ২০ তারিখে পাঠালেন একটি ভাস্কর্যের ছবি। ক্যাপশন : “বুননে, আমার শ্রেষ্ঠ সন্তান।” তিনি বিবরণ দিলেন এভাবে “আমার হাতেগড়া দীর্ঘসময় ছবি আঁকার জগতে সপ্তম স্মারক ভাস্কর্য। ঢাকা আর্ট কলেজে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবি আঁকার তালিম নিয়েছি। মূল বিষয় চিত্রকলা। কলেজে চতুর্থ বিষয় প্রিন্টমেকিং (তখন বলা হতো গ্রাফিক আর্ট) আর চ.বি-তে একটি বিষয় বাধ্যতামূলক ছিল ভাস্কর্য। আমার শিক্ষাগুরু শিল্পী রশিদ চৌধুরীর দীর্ঘ একটানা ৬ঘণ্টা ‘ছবি কি’ এ-বিষয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই ‘এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান’। মুক্তিযুদ্ধের কৃষকের প্রতিনিধি নিজ অর্থায়নে স্মারক ভাস্কর্যটি করা। জনৈক বীর মুক্তিযোদ্ধার অনুরোধে তিনি সকল অর্থের যোগান দিবে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়ন করেননি। স্বাধীনতা যুদ্ধে কোন কৃষকের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে কোন ভাস্কর্য আছে কি? আমার জানা নেই। অথচ কৃষকের সহযোগিতা না পেলে, আশ্রয় না পেলে দেশ নয় মাসে স্বাধীন হতো কিনা আমার সন্দেহ হয়। ভাস্কর্যটি গড়তে সহযোগিতা করেছেন রাজবাড়ী সৌখিন একজন ছাত্র ও একজন সাধারণ শ্রমিক। আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন রাজবাড়ীর জনপ্রিয় মান্যবর জেলা প্রশাসক জনাব দিলশাদ আরা। আমি এই ব্যক্তিত্রয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”

মনসুর-উল-করিম এরকম কতো ছবি, ভিডিও, পেইন্টিং, লেখা, কবিতা পাঠাতেন তার হিসেব নেই। দিনে অন্তত ৪/৫টি তো ছিলোই। ৩০ জুলাই সন্ধ্যা ৭.৪৫-টায় তিনি ম্যাসেজ দিলেন, “পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ২১ পদকপ্রাপ্তিতে আমাকে তথা বুনন আর্ট স্পেস, রাজবাড়ীর রাইনগরবাসীকে ঈদ মোবারক জানিয়েছেন। আমিসহ রাজবাড়ীর জনগণ গর্ববোধ করছি…।”  ৩১জুলাই সকাল ১০.০৫-টায় দিলেন ‘এজাজ, ঈদ মোবারক’।

এরপর ১৫ আগস্ট ৭.২৪-টায় তিনি ‘ফাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটি’ কর্তৃক শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রয়াণে পাঠানো একটি ভিডিও শেয়ার করলেন। ১৫ আগস্ট সকালে ৯-০৩-টায় ম্যাসেঞ্জারে লিখলেন “জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বুনন আর্ট স্পেস, রাজবাড়ী, প্রতিষ্ঠাতা আমি মনসুর-উল-করিম ১৪/৬ ফুট এই চিত্রটি নিবেদন করছি সংগৃহীত রাজবাড়ী জেলা পরিষদ কার্যালয়।” (বি.দ্র. তাঁর সবগুলো লেখা হুবহু রাখা হয়েছে শুধু বানান ঠিক করা ছাড়া) এর নিচে সেই পেইন্টিং এর ছবি।

শিল্পী মনসুর-উল-করিম শেষদিকে অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন। এবং তা নিমিত ম্যাসেঞ্জারে আমাকে পাঠাতেন। ১৭ আগস্ট সকাল ৭.২০টায় পাঠালেন-

নামে অন্ধকার

ঠাণ্ডু করিম

একটু কেবল বসতে পার

একপায়ে দাঁড়িয়ে আছি সোজা

ওঠে রবির আলো

আমাদের পায়ের নিচে ঝিলমিলিয়ে

মধ্যাহ্নে আমার ছায়াপরী পড়ে পায়ে

সাঁঝে দিগন্তরেখা ছুঁই ছুঁই

নামে অন্ধকার তারপর।

বসবে কি?

১৮ আগস্ট সকাল ৬.০৪-টায় পাঠালেন-

অনু কবিতা

ঠাণ্ডু করিম

সকাল হতে বাকি

তবু ভোর হয় নি।

তবু অপেক্ষা,

কিসের জন্য কার

আমার জন্য আমার।

তা কি করে হয়

হয়তো।

ভোর হয়েছে তবু বিছানায়

আছি আরাম আয়েসে,

পাশে ইজেল দাঁড়িয়ে

সাদা পট আরো সাদা,

আছে আমারই অপেক্ষায়।

এই দু’টি কবিতা পড়ে বিশেষ করে শেষের কবিতার মধ্যে তাঁর মৃত্যুবোধ-এর পরিচয় মেলে। সাদা পট তাঁকে ডাকছে এই প্রতীকের মধ্যে দিয়েই সেটি ব্যক্ত হলো যেন! এরপর তাঁর অন্যান্য পাঠানো কবিতাগুলো হচ্ছে, ১. ঘোরে আর ঘোরে, ২. ঐ যে বৃক্ষ তার ছায়া, ৩. মেঘে ঢাকা আকাশ, ৪. শিরোনামহীন, ৫. বারি গ্রাম, ৬. নদী চন্দনা, ৭. এই যে নদী আমার চন্দনা। তাঁর শেষ কবিতাটির একটি পঙ্ধসঢ়;ক্তি উদ্ধৃত করছি। যেখানে তাঁর বাব-দাদার ভিটেয় শেষ ঘুমিয়ে পড়ার আকুতি আছে। “নিচে শেখ পাড়া/জুসুমুদ্দিন শেখের নাতি আমি/এ বাড়ি ঘুরে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে/দাদির আঁচলে/এখানেই শেষ ঘুমিয়ে যেতাম বুকে।”

তাঁর শেষ ম্যাসেজটি পেয়েছিলাম ২১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০.১২-টায়। “শিল্পী রশিদ চৌধুরী আর্ট গ্যালারী” সম্পর্কিত একটি ফেসবুক লিংক। আর মহান শিল্পী মনসুর-উল-করিম মারা গেলেন ৫ অক্টোবর। স্যার, যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।

লেখক: এজাজ ইউসুফী, কবি ও সাংবাদিক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট