চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

নবুয়ত প্রকাশপূর্ব রাসূলুল্লাহর (সা.) অলৌকিক কিছু ঘটনা

মুহাম্মদ নুর হোসাইন

৬ নভেম্বর, ২০২০ | ১:২৬ অপরাহ্ণ

নবি-রাসূল আগমনের ধারাবাহিকতায় শেষনবি হযরত মুহাম্মদ (দ.) শুভাগমন হয়েছে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আওয়াল সোমবার দিনের প্রথম প্রহরে। তাঁর আগমনের পাঁচ শত বছর পূর্বে এসেছিলেন হযরত ঈসা (আ.)। বুখারির এক বর্ণনায় উভয়ের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান ছয় শত বছর। মধ্যবর্তী এ সময়কে ‘যামানুল ফাতরাত’ বা নবি-রাসূলমুক্ত যুগ বলা হয়। হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাঈলের শেষ নবি। তিনি রিসালতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের উদ্দেশ্য আমার অনেক কিছু বলার ছিল। এখন সেগুলো বলে যেতে পারছি না। তবে যখন সেই সত্য আত্মা আসবেন তখন তিনি তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করবেন। তিনি নিজের থেকে কিছু বলবেন না, শুধু তাই বলবেন; যা (অহি) তিনি শুনবেন। তিনি অনাগত বিষয়গুলো তোমাদেরকে শুনাবেন” (জন, ১৬: ৭-৮, ১২-১৩)।

এভাবে পূর্ববর্তী ঐশী বাণীগুলোর মধ্যে শেষ নবির আগমনের কথা, তাঁর চরিত্র এবং তাঁর উম্মাহ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। এগুলোও তাঁর অলৌকিকত্ব। তবে তাঁর আগমনের নিকটতম সময়ে এবং আমগমকালীন কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যেগুলোকে তাঁর মুজিযা এবং আগমনী বার্তা হিসেবে ঐতিহাসিকগ মূল্যায়ন করেছেন। এগুলোকে আরবিতে ‘ইরহাছাত’ বলা হয়। তম্মধ্যে অন্যতম ছিল হস্তীবাহিনীর ঘটনা। ইয়েমেনের বাদশা আবরাহ চেয়েছিল মক্কায় অবস্থিত কাবার পরিবর্তে তাঁর নির্মিত ‘কালিস’ নামক গির্জাকে আরবদের তীর্থস্থানে পরিণত করতে। পবিত্র কাবাঘর ভেঙ্গে দিয়ে ‘কালিস’-এর পথ পরিস্কার করার সে মনস্থ করল এবং ৬০ হাজারের সৈন্যবাহিনী নিয়ে মক্কায় আগমন করল। তাদের বহরে হাতিও ছিল। তাই তাদেরকে পবিত্র কুরআনের ভাষায় ‘হস্তী বাহিনী’ বলা হয়েছে। ঐতিহাসিকদের ভাষায় সে বছরের নাম ‘আমুল ফিল’ বা হাতির বছর। মহানবীর আগমনের ৪০ বা ৫০ দিন পূর্বে এ ঘটনা ঘটেছিল। উক্ত বাহিনীর মোকাবেলা করতে কাবাঘরের তৎকালীন মুতাওয়াল্লি হযরত আব্দুল মুত্তালিব অপরাগতা প্রকাশ করে পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা একেবারে ছোট প্রজাতির পাখি দ্বারা আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং হস্তীবাহিনীকে ধ্বংস করেন। এটি আল্লাহর নবি (দ.)-এর শুভাগমনের অন্যতম লক্ষণ। এ ঘটনার বর্ণনায় সূরা ফীল অবতীর্ণ হয়। 

হযরত আবু উমামা (র.) আল্লাহর নবি (দ.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার আবির্ভাবের সূচনা কেমন ছিল? তিনি বলেন, ‘আমি আমার পিতা ইব্রাহিমের দোয়ার ফসল আর হযরত ঈসার সুসংবাদের প্রতিফলন। আর আমার মা যখন আমাকে গর্ভে ধারণ করেন তখন তাঁর দেহ থেকে একটি জ্যোতি বের হয়ে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ আলোকিত করেছিল’। (মুসনাদে আহমদ)। ‘আহমদ’ নামের একটি ব্যতিক্রমধর্মী তারকা আকাশে দৃশ্যমান হওয়া ছিল ইরহাছাতের অন্তর্ভুক্ত। ইহুদীরা ঐ তারকার মর্মার্থ জানত। এ সম্পর্কে হযরত হাসসান বিন ছাবিত (র.) বলেন, ‘আমি বয়সে সাত-আট বছরের ছিলাম। যা শুনতাম বুঝতে পারতাম। একদিন এক ইহুদীপ-িত তার সম্প্রদায়ের এক সমাবেশ ডাকলেন। উপস্থিত লোকজন সভা আহবানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,‘আহমদ’ নামক তারকাটি গতরাতে উদিত হয়েছে, যা হযরত মুহাম্মদের জন্মের প্রমাণ বহন করে।’ (বায়হাকি)। হযরত যায়েদ বিন আমরের সূত্রেও একই অর্থের ছহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

পাঁচবছর বয়সে আল্লাহর নবি (দ.)-এর বক্ষবিদীর্ণের ঘটনা ঘটেছিল। এটি একটি আধ্যাত্মিক অপারেশন, যাতে কোন রক্তক্ষরণ হয়নি। এটি ছহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি ছিল এমন যে, তিনি হযরত হালিমার তত্ত্বাবধানে থাকাকালীন একদিন মাঠে বালকদের সাথে খেলছিলেন। এমতাবস্তায় জিব্রাঈল (আ.) এসে তাঁকে শুয়ায়ে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করলেন এবং পবিত্র শরীরের একটি অংশ বের করে ফেললেন। অত:পর তাঁর হৃদপি- যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করে অপারেশনকৃত অংশকে একত্রিত করে আগের স্থানে স্থাপন করে দিলেন। বালকরা এ ঘটনা দেখে দৌঁড়ে গিয়ে হযরত হালিমাকে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ দিল। এতে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।

হযরত আনাস (র.) বলেন, আমি তাঁর বক্ষ বিদীর্ণের নিদর্শন দেখেছি। (ছহিহ মুসলিম)। শিশু মুহাম্মদ (দ.)-এর উসিলা দিয়ে হযরত আবু তালিবের দোয়া করা এবং সে দোয়া কবুল হওয়াও তাঁর নবুয়তের অন্যতম নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর শৈশবে মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। কুরাইশ লোকেরা হযরত আবু তালিবের নিকট এসে অভিযোগ করে যে, অনাবৃষ্টিতে গাছপালা শুকিয়ে গেছে। তাদের পরিবার-পরিজন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। আপনি একটু দোয়া করুন। তখন তিনি শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে বের হলেন এবং কাবা ঘরে ঠেস দিয়ে তাঁর হাত ধরে আল্লাহতায়ালার নিকট দোয়া করলেন। হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে প্রবল বৃষ্টি ঝড়ল। উপত্যকা ও বনজঙ্গল সজিব হয়ে গেল। যখন নবুয়তের দ্বাদশ বছর কুরাইশরা আল্লাহর নবি (দ.)-কে সমাজচ্যুত করে ‘শিয়াবে আবু তালিব’-এ (আবু তালিবের উপত্যকা) চলে যেতে বাধ্য করল তখন হযরত আবু তালিব অনাবৃষ্টির দিনে আল্লাহর নবির (দ.) উসিলায় দোয়া করা এবং কুরাইশদের দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি লাভের ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবিতাকারে বললেন, ‘মুহাম্মদ এমন পবিত্র সত্ত্বা, যার চেহারার উসিলায় আকাশ থেকে বারি বর্ষণ হয়, তিনি এতিমদের আশ্রয়দাতা আর বিধবাদের রক্ষাকারী।’ (ছহিহ বুখারি)।

হযরত মুহাম্মদের বয়স বারো বছর। চাচা আবু তালিব তাঁকে নিয়ে বণিক কাফেলার সাথে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন। তাঁরা সিরিয়ার ‘বুছরা’ শহরে পৌঁছলে জারজিস নামক বুহায়রা পাদ্রীগির্জা থেকে বের হয়ে আসলেন। ইতিপূর্বে কোন আরব বণিক কাফেলার উদ্দেশ্যে তিনি বের হননি। তিনি সরাসরি দলের মাঝখানে ঢুকে পড়লেন। বালক মুহাম্মদের বৃত্তান্ত শুনে ও নিদর্শন দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে, উনি শেষ নবি। তিনি তাঁর হাত ধরে উক্তি করলেন, ইনি বিশ্ব সরদার, আল্লাহর প্রতিনিধি। তাঁকে আল্লাহতায়ালা বিশ্বজগতের করুণা করে পাঠিয়েছেন। তখন হযরত আবু তালিব ও দলের বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রশ্ন করলেন, আপনি কীভাবে বুঝতে পারলেন? তিনি বললেন, ‘আপনারা যখন পাহাড়ের ঢালে চড়ছিলেন তখন প্রত্যেক পাথর ও গাছ-গাছড়া সিজদায় পড়েছিল; নবি ছাড়া অন্য কারো জন্য এটি করা হয় না। আমি তাঁকে নবুয়তের মোহর দিয়েও চিনতে পেরেছি, যা তাঁর কাঁধের নিচে আপেলের আকৃতিতে অঙ্কিত আছে। আমরা এমন নিদর্শন সম্পর্কে আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে পড়েছি।’ অত:পর তিনি তাঁদেরকে ভালভাবে আপ্যায়ন করালেন এবং হযরত আবু তালিবকে উপদেশ দিলেন যে, তিনি যেন সিরিয়ায় না গিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান। কারণ, এ বালকটি রোমান ও ঈহুদি কর্তৃক ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন হযরত আবু তালিব তাঁর অন্যান্য ছেলেসহ মক্কায় ফিরে গেলেন (তিরমিযি)।  এগুলো ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর নবুয়ত প্রকাশপূর্ব পর্যন্ত আরো বহু অলৌকিক ঘটনার কথা সিরাতকারগণ বর্ণনা করেছেন। সেগুলোর প্রত্যেকটির সনদ ছহিহ নয়। তিনি কোনদিন প্রতিমা পূজা করেননি। কোন অশ্লীল কাজে জড়িত হননি। কারো আমানতের খেয়ানত করেননি। অবিচার করেননি কারো প্রতি। ফলে তারা তাঁকে কালো পাথর স্থাপন সম্পর্কিত বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। উল্লেখিত ঘটনাবলীর যেমন আধ্যাত্মিক গুরুত্ব আছে তেমনি গুরুত্ব আছে জাগতিক। এগুলো যুগে যুগে সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের চর্চার প্রতি মানুষকে প্রেরণা যোগাবে।

লেখক: মুহাম্মদ নুর হোসাইন, সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট