চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনাকালে অনলাইন ক্লাশ : সমস্যা ও সম্ভাবনা

মো. দিদারুল আলম

৫ নভেম্বর, ২০২০ | ২:১৫ অপরাহ্ণ

সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে ধীরে ধীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করে। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জুম অ্যাপস, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ওয়েবএক্স, হোয়াটসআ্যাপ, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউবের মতো বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে ক্লাস করছে। এছাড়া সংসদ টিভিও বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস প্রচার করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ক’জন শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে? তারা কী শিখছে? তার কতটুকু গ্রহণ করছে? আর দীর্ঘসময় অনলাইন ক্লাস তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলছে? অনলাইন ক্লাস হোক বা শ্রেণিকক্ষে, ক্লাসের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, আপনি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখবেন না কী হারিয়ে ফেলবেন, সেটি নির্ভর করে ক্লাসের প্রথম দশ মিনিটের ওপর। অনলাইন ক্লাসে এটির গুরুত্ব আরও বেশি, কেননা শুরুর মিনিট দশেকের মধ্যে যদি আপনি আপনার শিক্ষার্থীদের ক্লাসে সম্পৃক্ত করতে না পারেন, তাহলে ক্লাসের বাকি অংশে সে সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। তাই চেষ্টা করুন ক্লাসের শুরুটা আকর্ষণীয় করতে। বিভিন্ন উপায়ে আপনি আপনার ক্লাসকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন। হতে পারে আপনি যে বিষয়ের ওপর পড়াতে যাচ্ছেন, সেই বিষয় সংশ্লিষ্ট কোনো ভিডিও দেখিয়ে ক্লাস শুরু করতে পারেন। স্বাভাবিক সময়ে অনেক শিক্ষকেরাই প্রতিটি ক্লাস ঘণ্টখানেক নিয়ে থাকেন। করোনাকালে এই নিয়ম থেকে একটু সরে আসার চেষ্টা করুন। মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের সামনে বসে দীর্ঘক্ষণ ক্লাস করে মনোযোগ ধরে রাখা শিক্ষার্থীদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে প্রতিদিন লম্বা সময় ধরে ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। সবকিছু বিবেচনা করে তাই এমনভাবে ক্লাস-লেকচার তৈরি করুন, যেন আপনার শিক্ষার্থীরাও মনোযোগ না হারায়, আবার আপনিও কাক্সিক্ষত উপায়ে ক্লাস পরিচালনা করতে পারেন। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ওয়ার্ক বা দলগত কাজ দিয়ে থাকেন। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের দলগতভাবে কাজ করার দক্ষতা বাড়ে, তেমনি ক্লাসে সম্পৃক্ততাও নিশ্চিত করা যায়। অনলাইনেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। জুম অ্যাপের মতো বেশির ভাগ ভিডিও কনফারেন্সিং টুলেই ‘ব্রেকআউট রুম’ এর অপশন রয়েছে, যেখানে আপনি শিক্ষার্থীদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে দিয়ে আলাদা আলাদা কাজ দিতে পারেন। একটানা লেকচার দেওয়ার বদলে এই কৌশল অবলম্বন করলে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। লেকচার শেষে শিক্ষার্থীদের কাছে সেদিনের ক্লাস সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ৫-১০ মিনিট সময় বরাদ্দ রাখুন। এতে একইসঙ্গে দুটো কাজ হবে। শিক্ষার্থীরা আপনার লেকচার বুঝতে পারছে কি না সেটি বুঝতে পারবেন, আবার অংশগ্রহণমূলক ক্লাসও নিশ্চিত হবে। বর্তমানে অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের সুবিধা সবাই গ্রহণ করতে পারছে না। এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালযয়ের প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারছে না। কারণ অনেকেরই অনলাইন ক্লাস করার জন্য স্মার্টফোন, কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ নেই।

গ্রাম, চর, হাওর অথবা দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভার্চ্যুয়াল শিক্ষা সম্পর্কে কোনো ধারণা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। রাজধানী ও দেশের বিভাগীয় শহরগুলো ছাড়া অন্যান্য জেলা ও উপজেলায় থ্রিজি/ ফোরজি নেটওয়ার্ক বা ব্রডব্যান্ড সুবিধা সহজে দেখা মেলে না। ফলে দুর্বল নেটওয়ার্ক দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ক্লাস করার সুবিধা সবাই পাচ্ছে না। আবার অনেকের বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে যেখানে সংসার চালানো মুশকিল হচ্ছে, সেখানে ইন্টারনেটের খরচ বহন করা তাদের জন্য খুব কষ্টসাধ্য।

অনলাইনে ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক শিক্ষক ক্যামেরা-ভীতিতে ভুগছেন। তাঁরা সুন্দর, সাবলীল, বোধগম্য ও আকর্ষণীয় লেকচার দিতে পারছেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছে। অনলাইনে ক্লাস করে শিক্ষার্থীরা তাদের সব পড়া সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না, আর না বুঝলে শিক্ষকদের কাছে আবার প্রশ্ন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই অনেক বিষয়ে পড়াশোনায় ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থী কী শিখছে, তা পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাই পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাস করার জন্য বিভিন্ন ডিভাইসের স্ক্রিনের সামনে দীর্ঘসময় বসে থাকায় ছাত্রছাত্রীদের চোখে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আবার কারও কারও মাথাব্যথা অনুভূতি হচ্ছে। দীর্ঘসময় চেয়ারে বসে ক্লাস করায় অনেক শিক্ষার্থীর ঘাড়ে ও পিঠের মেরুদ-ে ব্যথা হচ্ছে। ছোট ছোট শিশুরা অনলাইন ক্লাসের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হচ্ছে, যা তাদের বয়সের সঙ্গে খাপ খায় না। সময়ের আগে কোনো কিছুই ভালো না জেনেও পরিস্থিতির কারণে আমরা আজ তাদের ফেসবুক, ইউটিউব চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছি, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে এই করোনাকালে সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের জন্য বিনামূল্যে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা দিতে হবে। বাংলাদেশের সব জেলায় ফোর জি ইন্টারনেট অথবা ব্রডব্যান্ড–সুবিধা দিতে হবে। শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাসের কোর্সের আওতায় আনতে হবে। যেন তাঁরা নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারেন। শিক্ষার্থীরা যেন অতিরিক্ত অনলাইন আসক্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। করোনা ও উপর্যুপরি বন্যায় মধ্যবিত্তসহ নিম্ন আয়ের মানুষ আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় সন্তানদের ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা স্মার্টফোন কিনে দেয়া তো দূরের কথা, দু’বেলা দু’মুঠো আহার জোগাতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অনলাইন ক্লাসের জন্য সন্তানের হাতে ন্যূনতম একটি স্মার্টফোন তুলে দেয়ার সামর্থ্য নেই মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন আয়ের অনেক অভিভাবকের। ফলে এসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ কথা সত্য অনেক শিক্ষকের ইন্টারনেট ও অনলাইন ক্লাশ নেয়ার ব্যাপারে অদক্ষতা রয়ে গেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষতার অভাব থাকায় বাইরের দক্ষ ব্যক্তিদের সাহায্য নিয়ে অনলাইনে ক্লাস নিতে হচ্ছে শিক্ষকদের। এ অবস্থায় অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে হলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষ করে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: মো. দিদারুল আলম,প্রাবন্ধিক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট