চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

গণতন্ত্রের ক্রেতা-বিক্রেতা

ড.ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

৩ নভেম্বর, ২০২০ | ২:৩৪ অপরাহ্ণ

আমরা সম্যক অবগত আছি যে, যে কোন সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্র রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল্যায়নে সর্বোচ্চ প্রণিধানযোগ্য একটি নৈতিক-আদর্শিক মানদণ্ড। রাষ্ট্র বা সরকারপদ্ধতিকে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন মাপকাঠিতে অগ্রগণ্য করার সম্পূরক-পরিপূরক অনুষঙ্গ হচ্ছে গণতন্ত্র। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের শাসননীতিকে ধারণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাধান্যে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য; সমসাময়িক বিশ্বে প্রায় প্রতিটি দেশেই গণতন্ত্র প্রাত্যহিক বাচনিক ব্যঞ্জনায় প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গিকে আড়াল করে রাখছে। কেন জানি মনে হচ্ছে গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা-ভাবনা এবং এর দৃশ্যমান বাস্তবায়ন বহুলাংশে নির্বাসিত। এই প্রত্যয়ের বিভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা জাতি-রাষ্ট্রকে করে তুলছে কলুষিত ও বিপর্যস্ত। গণতন্ত্রের চর্চা ও পরিচর্যার বিচ্যুত পন্থা শুধু সমালোচিত নয়, প্রচণ্ড নিন্দিতও বটে। নিজের মতামত অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়া গণতন্ত্রের অনবদ্য দৃষ্টান্তকে সার্থক উপস্থাপনে কঠিন প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ।

ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে স্বাধীন মতামত প্রকাশ গণতন্ত্রের নৈর্ব্যত্তিক বৈশিষ্ট্য হলেও অন্য সম্প্রদায়-ব্যক্তি-গোষ্ঠীর মর্মবেদনার কারণ হতে পারে এমন কিছু বিষয় প্রকাশ গণতন্ত্রের নির্যাস নয়। গণতন্ত্র কোনভাবেই বস্তু বা পণ্য হতে পারে না। এর উপযোগিতা সহজ মুদ্রামূল্যে নির্ধারণ বা ক্রয়-বিক্রয়ের অমূলক সূচকে পরিণত করা চরম গর্হিত প্রক্রিয়া। এতে শুধু কোন নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠী সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; বরং পুরো বিশ্বব্যবস্থাই কল্পনাতীত সঙ্কটে নিপতিত হবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতিমান দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলেছিলেন, Man is born free but everywhere he is in chain. অর্থাৎ জন্মগতভাবে মানুষ স্বাধীন হলেও জীবনযাত্রার সর্বত্রই সে শৃংখলাবদ্ধ। ক্ষুদ্র শাসকশ্রেণি কর্তৃক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শাসন-শোষণের যে প্রবাহমানতা; তার অনুর্বর ধারা বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এবং বিধি-বিধানের কঠিন আবরণে মানুষের জীবনযাপনকে সাবলীল কৃষ্টি-ঐতিহ্য-জীবনমানকে শৃংখলিত করতে পারে না। মানুষের সহজাত বেড়ে ওঠার পরিক্রমায় মানবিক বিকাশধারাকে সমুন্নত রেখে স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি ও অবারিত মূল্যবোধ তথা সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও আনন্দের মননশীল চিন্তা-চেতনা গণতন্ত্রের সৌকর্যকে সমৃদ্ধ করে।

রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি সমাজে ক্রমবিকাশের ধারায় প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০০ বছর পূর্বে হেরোডেটাস কর্তৃক প্রণীত গণতন্ত্রের ধারণাকে এখনও স্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর অতি নিকটতর মনে করা হয়। আদিম মানবগোষ্ঠীর সহজ-সরল শাসন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ধরে রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে জনগণ উত্তম ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকে বেছে নেবে- এই ইঙ্গিত প্রায় সকল সমাজ ও রাষ্ট্র দিয়ে গেছে। আমরা জানি, প্রাচীন গ্রীস ও রোম এর সরকার পরিচালনায় নাগরিকের অংশগ্রহণের অধিকার প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রীসে সীমিত সংখ্যক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকেরা সরাসরি ভোট দিত। কিন্তু এসব গণতন্ত্রে নিম্নবিত্ত কিংবা ক্রীতদাসদের কোন স্থান ছিল না। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার বহু পূর্বে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্ট সরকার চালু ছিল।

ইংল্যান্ডে প্রায় হাজার বছর পূর্বে হাউজ অব ল’স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ইংল্যান্ডে আইন প্রণয়নে হাউজ অব কমন্স এর অংশগ্রহণ কারো অজানা নয়। সামগ্রিক অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব থেকেই অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সংখ্যালঘিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংসদীয় শাসন পরিচালনা করত। এই সংসদীয় কাঠামো বজায় রেখে ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক পরে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরেও বহুকাল ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। আধুনিককালে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের আইন পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার যে ব্যবস্থা, তাকেই বর্তমানে গণতন্ত্রের মূল প্রত্যয় হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মূলত এর উৎপত্তির পিছনে রয়েছে শিল্পবিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ফরাসী বিপ্লবের যে দার্শনিক ভিত্তির গোড়াপত্তন তথা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার চেতনার বাস্তব অভিব্যক্তি। এর সর্বোত্তম উপমা উন্মোচিত হয়েছে আব্রাহাম লিংকনের ইতিহাসসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সরকারের সংজ্ঞায় – Government of the people,by the people and for the people. যদিও ইংল্যান্ডে বেশ কিছুকাল আগেই রাজা কর্তৃক নাগরিকদের সনাতন অধিকার খর্ব করার প্রতিবাদে সপ্তদশ শতাব্দীতে সংঘটিত সংঘাতের ফলশ্রুতিতে প্রণীত  The petition of Right,1628, Ges The Bill of Rights,1629 রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনসভা ও বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদাহরণ রয়েছে, গণতন্ত্রের আদর্শকে উজ্জীবিত করার মৌলিক ধারাবাহিকতা ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন ও ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের গৌরবগাঁথায় পরিপূর্ণ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর লাস্কির ভাষায় ‘কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রদত্ত অধিকার দ্বারা’ এবং গণতন্ত্রকে যথার্থ মর্যাদায় আসীন রাখতে পারে জনগণের সঠিক চেতনা ও সতর্ক পাহারা যেটি লাস্কির ভাষায়- eternal vigilance is the price of liberty. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা গুটিকয়েক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর ক্ষমতা করায়ত্তের মাধ্যমে গণতন্ত্র অনুশীলন করা হলেও এটি গণতন্ত্রকে `least arbitratiry and most responsible,least drastic and most considerate.’ অর্থাৎ ‘সবচেয়ে কম স্বৈরাচারী সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল, সবচেয়ে কম কঠোর এবং সবচেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল’ বৈশিষ্ট্যের কারণে প্যারেটো, র‌্যাকো এবং সমবার্ট এর মত কতিপয় সমাজ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যতীত প্রথিতযশা প্রায় সকলেই গণতন্ত্রের দুর্বলতা, অপূর্ণতা ও অপপ্রয়োগ স্বীকার করেও এর অপরিহার্যতা দারুণ সমর্থন করেছেন।

গণতন্ত্র চর্চা ও অনুসরণ পটভূমিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও মুক্তি তথা মানবজাতির মুক্তির সনদ হিসেবে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২১তম অনুচ্ছেদের ৩নং ধারা বিশেষভাবে  উল্লেখযোগ্য। ‘সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি হবে জনগণের ইচ্ছা যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সার্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গোপন ভোটের মাধ্যমে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলন’ জাতিসংঘ ঘোষিত এ নীতিমালা গণতান্ত্রিক ধারাকে সমগ্র বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। অনুচ্ছেদের ১নং ধারা বিশ্বের প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্বাধীনভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ যথার্থভাবে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা সমুজ্জল হয়েছে। গণতন্ত্র শুধু যে সরকার সম্পর্কিত তথ্য তা কিন্তু নয়। আধুনিক গণতন্ত্রের বিজ্ঞত্বাত্ত্বিক লিন্ডসের ভাষায়, গণতন্ত্র একটি সামাজিক প্রক্রিয়া বটে। এটি মূলত: কতগুলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বয়, পরিচর্যা ও প্রতিফলন।

গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা তথা চিন্তা, বাক, সংগঠন, ভোট দান, দলগঠন, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ও অংশগ্রহণ, ভোট প্রদান, অভিযোগ স্থাপনের যথার্থ স্বাধীনতা। সার্বিকভাবে জীবনধারণ, পরিবার গঠন, নিরাপত্তা, আইনের আশ্রয়প্রাপ্তি, স্বাধীন মতামত প্রকাশ, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করা ও বিরোধিতার অধিকার ইত্যাদি সকল কিছুকেই অন্তর্ভূক্ত করে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিত্ব বিকাশের সাথে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা। দার্শনিক ভল্টেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) বলেছেন, ‘তোমার মতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব’। উপরোক্ত বিষয়সমূহের পর্যালোচনায় সমধিক বিবেচিত বিষয় হচ্ছে, পরিশুদ্ধ গণতন্ত্রের মোড়কে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে সুশাসনের কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান করা না হলে যে কোন জাতি-রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের চলমান কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকতায় প্রশ্নবিদ্ধ এবং জনগণের আস্থা অর্জনে সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

বিগত কয়েক দশক বাংলাদেশের জনগণ অবলোকন করছে যে, রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে দ্রুততার সাথে অনৈতিক ব্যবসা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য পেশী-তদবির-অপকৌশলের মাধ্যমে বেশকিছু দুর্বৃত্ত দেশকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। দারুণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে নিরন্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সৎ ও সত্যবাদীতার বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতিতে এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে, অন্যথায় রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও আগ্রহ কমে যাবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হবে। রাজনীতি তখন আর রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।’ রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য মূলতঃ সৎ ও সুন্দর কর্ম দিয়ে জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করা। এটি কোনভাবেই আরোপিত নয়, অবশ্যই অর্জিত একটি মহৎ গুন। হয়তো বংশপরম্পরায় যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নেতৃত্বের শিখরে পৌঁছুনো অনেকের পক্ষে সম্ভব, কিন্তু তা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ন্যূন্যতম মেধা, ত্যাগ, যোগ্যতা অর্জন না করে ছলচাতুরীর মাধ্যমে রাজনৈতিক বদান্যতায় সাময়িক বিভিন্ন পদ-পদবী দখল করা যায়, তবে তা সততা, সত্যবাদীতা, আদর্শের বিপরীত স্রোতে প্রবাহমান এবং কাল-অতিক্রান্তের অবশ্যই ঘৃণ্য ও বর্জনীয় – এটিই ইতিহাস স্বীকৃত।

গণতন্ত্রের মানসপুত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মূর্ত প্রতীক বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তনয়া গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশের বর্তমান শাসনকার্য পরিচালনা করছে। বস্তুতপক্ষে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করেছে তা ছিল গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে শোষণমুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। এক কথায় যেটিকে বলা যায় স্বাধীনতার রূপকল্প বা মোদ্দাকথায় গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সকল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা সুষম এবং স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহের ক্রোড়পত্র। দেশে অহরহ গণতন্ত্র নস্যাতের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, অপচেষ্টা ও ব্যর্থ পরিকল্পনা জনগণ প্রতিনিয়ত অবলোকন করছে। এতে শুধু জনগণের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে না, বরং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশবাসী যারপরনাই সন্দেহ-সংশয়ে আশঙ্কাগ্রস্ত। সাম্প্রতিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্যে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ এবং দেশের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সজাগ থাকার বিষয়টি বার বার ওঠে আসছে। গণতন্ত্রকে অধিকতর মজবুত করার লক্ষ্যে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় এর বুনিয়াদ অব্যাহতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কৌশল ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়িত হোক- এটিই জনগণের প্রত্যাশা। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থে যেনতেনভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা কোনভাবেই সুষ্ঠু ও সুস্থ গণতান্ত্রিক গতিধারাকে সুসংহত করতে পারে না। এর অন্যথা হলে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা অন্যান্য অপশক্তিগুলো শক্তিশালী হবে এবং দেশের উন্নয়ন প্রচন্ড বাধাগ্রস্ত হবে, নিঃসন্দেহে তা বলা যায়।

এটি সত্যি যে, বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস তেমন সমৃদ্ধ ও সুখপাঠ্য নয়। বার বারই মানুষের চাওয়া-পাওয়া এবং পরিবর্তনের স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়ে সামরিক শাসকরাই এই অঞ্চলকে শাসন করেছে দীর্ঘকাল। মূলত এই উপমহাদেশের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের লক্ষ্যেই ১৯৪৭ সালে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র। শুধু ইংরেজদের আমলে নয় তারও বহুকাল আগে থেকেই এদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল স্বৈরচারী এবং তার ভিত্তি ছিল এক অনড় সমাজ কাঠামো। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই জিন্নাহর ক্ষমতা কাঠামোর মূলে ছিল আমলাতান্ত্রিক শক্তির প্রচ- প্রভাব। রাজনৈতিক সহকর্মী ও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি জিন্নাহর ছিল গভীর অবজ্ঞা, যা পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই এর মাধ্যমে সামরিক শাসকদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা কর্তৃক ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি এবং ধারাবাহিকভাবে জেনারেল আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানের মত সামরিক জান্তাদের শাসন-শোষণ এদেশের রাজনৈতিক সামাজিক এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক উন্নয়নে কী ধরণের বিরূপ প্রভাব ফেলেছে; তা এদেশের সকলেরই জানা।

পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক শাসকগোষ্ঠীর ২৩ বছরের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফার মধ্যে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সকল অনাচার ও শোষণ বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে জাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে রূপকল্প স্পষ্ট করেছিল, ১৯৭০ এর নির্বাচনে মানুষের অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক রায়ে তার গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন ঘটেছিল। সামরিক শাসকরা তাকে ভূলুন্ঠিত করে গণতন্ত্রকে চিরতরে নস্যাতের পরিকল্পনার বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন বলেই নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ সাংসদদের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, নির্বাচনের বিজয় জনগণের অধিকার আদায় সমার্থক নয়। বিজয় নস্যাতের ষড়যন্ত্র চলছে দাবি করে বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁকে চিরতরে বিদায় নিতে হলেও তাঁর সহকর্মীগণ যেন আন্দোলন করে জনগণের দাবি আদায় করতে পিছ পা না হন, সে সম্পর্কে সকলকে সজাগ এবং ঐক্যকদ্ধভাবে সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে গণতান্ত্রিক বিষয়কে সুসংহত করার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা সেই কুৎসিত পাপাচার-কদাচার ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করি। যার ফলে সৃষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং কায়েমি স্বার্থবাদীদের কু-চক্রের শিকার ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এবং তারই ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদেরই উত্তরসূরিদের বাংলাদেশ শাসন-শোষণ।

আমরা জানি যে, কোন অধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছাড়া কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোনভাবেই সম্ভব নয় এবং এটিই সর্বজনবিদিত সত্য যে, তৃণমূল পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততা এবং আর্থিকসহ সকল বিষয়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা ছাড়া রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের কার্যকারিতার দৃঢ়ভিত্তি রচনা করতে পারে না। ‘প্রতিহিংসা নয় এখন ক্ষমার সময়’- ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে জননেত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণা গণতন্ত্রের মূল কথা- সমঝোতা ও সহমর্মিতাকেই যে কত বলিষ্ঠভাবে স্পষ্ট করেছে তা সচেতন সকল মহলেরই জানা। নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সহনশীল হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণতা পরিত্যাগ করে ধৈর্য্যরে সাথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এবং সকল দলের অস্তিত্বকে যথাযথ মূল্যায়ন করে বিরোধী দলসহ সকলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহবান, এদেশের গণতন্ত্রের সংস্কৃতিকে বিপুল উজ্জীবিত করেছে। দেশ ধ্বংস বা জনগণের দুর্ভোগের কারণ না হলে সকল দল-মতের অবাধ প্রচার ও প্রকাশ, যৌক্তিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম ইত্যাদির সুচারু পথ বাধাগ্রস্ত করা কোনভাবেই সমীচীন নয়। আলাপ-আলোচনা-সংলাপ-সমঝোতা-সৌহার্দ-সম্প্রীতির অপার মেলবন্ধনে পরিশুদ্ধ-পরিপুষ্ট গণতন্ত্র নির্বিঘ্নে প্রতিষ্ঠিত হোক- এই প্রত্যাশায় নিবন্ধের ইতি টানছি।

প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী শিক্ষাবিদ,

সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট