চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বলুন ‘খবরটি সত্যি নয়’

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

২৭ অক্টোবর, ২০২০ | ৩:৪২ অপরাহ্ণ

ফেসবুকের খবর মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র সরকার বিক্রি করে দিচ্ছে। ঢাকার কোনো একটি বাংলা দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে গত ৪ বা ৫ অক্টোবর এমন একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। তা চোখে পড়েছে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদারের এবং তিনি বেদনার্ত হয়ে বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। সেটি পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও অধুনা ফেসবুক একটিভিস্ট রায়হান ফিরদাউস মধু ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। মে. জে. শিকদার আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষেরই লোক। আমি যখন জনকণ্ঠে ছিলাম, তখন তাঁর লেখা সে পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। সুতরাং তিনি বিদ্বিষ্ট হয়ে খবরটি ছড়িয়ে দিয়েছেন এমনটি মনে করার সুযোগ নেই।
খবরে বলা হয়েছে ২৬ হাজার বা তার কিছু বেশি অস্ত্র, যেগুলি মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিলো এবং এতদিনের অব্যবহারে অকেজো হয়ে লোহা-লক্কড়ে পরিণত হয়েছে, সেগুলি রাখার কোনো জায়গা না পেয়ে সরকার বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। জার্মান সরকার নাকি এই অস্ত্রগুলি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে দর কষাকষি করছে।

খবরটি সত্য না মিথ্যা বলতে পারছি না। মিথ্যা হলে সরকার নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করতেন। হয়তো সত্যি না হলে বাকপটু মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী মোজাম্মেল মুখে কুলুট এঁকে চুপচাপ থাকতেন না। যদি সত্য হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃসংবাদ আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। সবচেয়ে বড় মর্মান্তিক ঘটনা হলো বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যা। এখন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র বিক্রির কথা যদি সত্য হয়, তা’ও হবে অনুরূপ এক দুঃখজনক ঘটনা।

আরো বড় কথা হলো অস্ত্র বিক্রি করতে যাচ্ছে এমন একটি সরকার, যে সরকার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সরকার; বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে সরকারের প্রধান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও এক সময় এদেশের ক্ষমতায় ছিলো, স্বাধীনতাবিরোধী সেই শক্তিও এমন সিদ্ধান্ত নেয় নি। ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় অর্ধশতাব্দি অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কখনো মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র বিক্রির কথা ওঠে নি। কেউ ভাবেনি সে কথা, দূর কল্পনায়ও কারো মাথায় সে চিন্তা প্রশ্রয় পায় নি। খবরটি তো খারাপ। যে দিকটা সবচেয়ে বেশি খারাপ সেটি হলো আওয়ামী লীগ সরকারই অস্ত্রগুলো বেচে দিতে চাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত খবরটার প্রতিবাদ জানানো হয়নি। এখানেই রহস্য। আবার খবরটা যতি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কোনো পত্রিকা, বিশেষ করে মূলধারার কোনো দৈনিক অনুসন্ধান চালিয়ে আর একটি সংবাদ প্রকাশ করলো না কেন? এখানেই সন্দেহ জাগে খবরটি কি তাহলে সত্য নয়?

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র বিক্রি করার অধিকার কারো নেই। জামায়াত-বিএনপি তো নয়ই, এমনকি আওয়ামী লীগও নয়। যে অস্ত্রগুলো দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন, সেগুলি মামুলি যুদ্ধাস্ত্র নয়; যুদ্ধটা ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন। সুতরাং এই অস্ত্রগুলোর সঙ্গে জাতির মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতার স্পৃহা গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। ঐ অস্ত্র জাতির পরম সম্পদ, ওই অস্ত্র দিয়েই জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে বিতাড়িত করেছিলেন। সুতরাং ওই অস্ত্রগুলো জাতির বীরত্বের, শৌর্যবীর্যের প্রতীক; জাতির গৌরবময় কীর্তির জ্বলন্ত প্রমাণ।

অস্ত্র যদি বিক্রি হয়ে যায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের প্রমাণ লোপাট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আপসের চোরাগলি পথে নয়, উন্মুক্ত রাজপথে রক্তের হোলি খেলতে খেলতে, অস্ত্রের গর্জনে এসেছিলো। ওই রক্তাক্ত যুদ্ধ, যা’ মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত, সেই যুদ্ধের উপকরণের মধ্যে শুধু অস্ত্রগুলোই তো অবশিষ্ট আছে। তাকে কিভাবে পরিত্যাগ করা যায়? জাতির আবেগ, চেতনা একদিন যুদ্ধের মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তানি নরঘাতক দস্যুদের ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলো। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র তো শুধু অস্ত্র নয়, জাতির অস্তিত্বের নিদর্শন। সেই অস্ত্র বেচে দেয়ার কথা শুনলে মনে হয়, বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এই অস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি করে সেখানে সংরক্ষণ করতে হবে।

জাতির অনাগত প্রজন্ম যাতে অস্ত্র দেখে তার পূর্বপুরুষের গৌরবময় কীর্তির কথা জানতে পারে, স্মরণ করতে পারে। যোদ্ধা জাতির সংগ্রামী ঐতিহ্য ওই অস্ত্রের মাধ্যমেই বাঙালির প্রতি প্রজন্মের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়ে যাবে। অস্ত্রগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে বিক্রির উদ্যোগ কেন নিচ্ছে সরকার। সেগুলি কি সরকারের জন্য বোঝা হয়ে গেছে? আর জাদুঘর করলেই তো অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। মাথা ব্যথা হলে যেমন কেউ মাথা কেটে ফেলে দেয় না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র রাখতে সমস্যা হলে সেগুলো বেচে দেয়া যায় না।
সরকার এখানে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে টেলিভিশনে প্রতিদিন একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। যেখানে কারো কাছে নৌযুদ্ধের বা নৌ বাহিনীর কোনো উপকরণ বা দলিল থাকলে তা’ জমা দিতে বলা হয়। সরকার একদিকে মুক্তিযুদ্ধের উপকরণ মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে যেসব উপকরণ সরকারের হাতে আছে, সেগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে।

এই অস্ত্রগুলো তো মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র; যেগুলি তারা স্বাধীনতার পরপর জাতির পিতার আহবানে ঢাকায় গিয়ে তাঁর হাতে জমা দিয়েছিলেন। সুতরাং এই অস্ত্রগুলোর সঙ্গে জাতির পিতার স্মৃতিও জড়িত রয়েছে। আশা করি, জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে সরকার তাঁর স্মৃতি ধ্বংস করে দেবে না। আচ্ছা, সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হচ্ছে না কেন? আমরা মাননীয় মন্ত্রী জনাব একেএম মোজাম্মেল হককে অনুরোধ জানাবো তিনি যেন একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেন খবরটি সত্য নয়।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট