চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কিশোর গ্যাং : পারিবারিক এবং সামাজিক প্রতিরোধ জরুরি

মোহাম্মদ শাহজাহান

২২ অক্টোবর, ২০২০ | ৩:০৮ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে একাধিক খুনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এরকম ‘গ্যাং কালচার’র নামে সারাদেশে কিশোরদের একটি অংশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তারা পাড়া-মহল্লার প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নামধারী মাস্তান বা বড় ভাইদের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। দলবেঁধে মাদকসেবন করার পাশাপাশি তুচ্ছ ঘটনায় মারামারি ও ঝগড়া ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ছে এসব কিশোর। এতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে।

‘ভার্চুয়াল’ জগতে ‘সিক্রেট গ্রুপ’ তৈরি করে এরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করছে। সেখানে ভয়ঙ্কর ‘সিক্রেট মিশনের’ খুঁটিনাটি বিষয়ের পরিকল্পনা করছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের রয়েছে বাহারি সব নাম। অনেক সময় দেখা যায় তাদের গ্যাংপ্রধানরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে কিশোরদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের নামেও তারা কিশোরদেরকে অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেলছে। স্থানীয় বড় ভাইদের আশির্বাদপুষ্ট এসব কিশোরদের উৎপাতে চট্টগ্রাম বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামের বাসিন্দারাও অতিষ্ঠ।

সংবাদমাধ্যম বলছে, চট্টগ্রামে উঠতি-ছিচকে মাস্তান ও কিশোর গ্যাংগ্রুপ এখনো অনেকটাই অধরা। অথচ এসব গ্রুপ সারাদেশের মত চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়, গ্রামে সামাজিক স্বস্তি কেড়ে নিতে শুরু করেছে। অভিভাবকসহ পরিবারের ছোট-বড় সকলেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বখাটেপনা বা মেয়েদের উত্যক্ত করা ছাড়াও হত্যাকা-সহ ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর বড় কারণ পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা। এখন খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। তারা ইন্টারনেটে মারামারির গেম খেলছে, হরর ফিল্ম দেখছে, এগুলো তাদের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। তবে গ্যাং তৈরি হওয়ার পর খুব দ্রুতই অন্য এলাকার গ্রুপগুলোর সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়। অনেক সময় তুচ্ছ কারণেও ঘটে যায় মারামারির ঘটনা।

অনেক সময় দেখা যায়, এক এলাকার ছেলে অন্য এলাকায় গেলেও মারধরের ঘটনা ঘটে। কাউকে গালি দিলে, যথাযথ সম্মান না দেখালে, এমনকি বাঁকা চোখে তাকানোর কারণেও মারামারির ঘটনা ঘটছে। মেয়েলি বিষয় এবং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব থেকেও মারামারি হচ্ছে। কিশোর গ্যাংকে কাজে লাগিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা ধান্ধা করে গডফাদাররা। ছিনতাই থেকে মাদক পাচারের মতো কাজও করানো হয়।

মূলতঃ দুটি কারণে কিশোররা এসব গ্যাং-সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ছে। প্রথমতঃ মাদক, অস্ত্রের দাপটসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। দ্বিতীয়তঃ এখনকার শিশু-কিশোররা পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট মনোযোগ পাচ্ছে না। ফলে কিশোরদের কেউ যখন বন্ধুদের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংগুলোতে ঢুকছে এবং মাদক ও অস্ত্রের যোগান সহজেই পেয়ে যাচ্ছে। তখন তার প্রলুব্ধ হওয়া এবং অপরাধপ্রবণ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের গ্রামগুলোতে এই গ্যাং-কালচার তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে, যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় জুভেনাইল সাবকালচার। অনেক সময় বঞ্চনা থেকে কিশোরদের মধ্যে এমন দল গড়ে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও বীরত্ব দেখাতেও ছেলেরা মাস্তানিতে যুক্ত হয়।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের কিছু রাজনৈতিক নামধারী ব্যক্তি নির্বাচনী কাজে কিশোরদের অপব্যবহারের (প্রতিপক্ষের সাথে সংঘাত) জন্য তাঁদেরকে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পার্কসহ বিনোদনকেন্দ্র এবং অনেক পাড়া-মহল্লা এখন এসব উঠতি মাস্তানদের দখলে। কিশোর গ্যাংগুলো একেকটি এলাকার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছে। অনেক এলাকাতেই তাদের কথার বাইরে কিছু হচ্ছে না। তাদেরকে গ্রামের বিভিন্ন অপকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে। ছোটখাটো ঘটনায় কিশোরদের মধ্যে ঝগড়া হয়। কিন্তু সেটা যাতে সহিংসতার দিকে না যায়, সে ব্যাপারে এলাকার মুরুব্বি ও অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। এ বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। অভিভাবকদেরকে দেখতে হবে ছেলেমেয়েরা কে কী করছে। কিশোর গ্যাংয়ে কেউ যেন সম্পৃক্ত হতে না পারে সেদিকে তাদের সজাগ থাকতে হবে। তবে একদিকে যেমন সমাজে অপরাধী হওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে পরিবারে কিশোরদের একাকী বা বিচ্ছিন্ন না রেখে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। কিশোর-তরুণদের গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত করতে হবে। কিশোরদের গ্যাং সংস্কৃতি এবং অপরাধ বন্ধ করতে স্কুল-কলেজ, অভিভাবক এবং সুশীল সমাজের সমন্বয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ খুবই জরুরি। প্রশাসনের উচিত অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংসহ অন্য সব গ্যাং নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। যাতে কোনো কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব না থাকে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট