চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শতবর্ষের প্রাক্কালে চট্টলদরদী

ড. মাহফুজ পারভেজ

১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ২:২১ অপরাহ্ণ

‘চট্টলদরদী’ আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ স্পর্শ করবে আগামী বছর ২০২১ সালে। চট্টগ্রামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, সাংবাদিকতা ও উন্নয়ন অভিযাত্রায় ‘চট্টলদরদী’র জন্মশতবর্ষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
চলতি ২০২০ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে এবং তাঁর ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় এই মহান কর্মবীরকে স্মরণ ও আলোচনার পাশাপাশি তাঁর জন্মশতবর্ষ বহুমাত্রিক তাৎপর্যময়তায় পালনের প্রতীতি ও দায়িত্ব গ্রহণ করাও আমাদের সকলের, বিশেষত চট্টগ্রামবাসীর আবশ্যিক কর্তব্য। কারণ চট্টগ্রাম জনপদের মহত্তম ব্যক্তিবর্গের স্মরণ ও আলোচনার মাধ্যমে অতীতের গৌরবগাঁথা যেমনিভাবে পুনরুজ্জীবিত হবে, তেমনিভাবে রচিত হবে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় পথ।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বেঁচে থাকলে তিনি শতায়ু হতেন। কিন্তু কর্ম ও কীর্তিতে তিনি অনুপস্থিত থাকলেও জাগ্রত আছেন চট্টগ্রামবাসীর চিত্তে। এটাই আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর অনন্য বৈশিষ্ট্য যে, তিনি মৃত্যুতেই বিস্মৃত হননি, বরং কর্মের দীপ্তিতে, ব্যক্তিত্বের প্রাখর্যে সদা-দেদীপ্যমান রয়েছেন।

ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির উত্তরাধিকারে ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর উত্তর চট্টগ্রামের রাউজানের ঢেউয়া হাজিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আলহাজ দুলামিয়া এবং মাতার নাম আজিজা খাতুন। জন্মের পর থেকেই গ্রামীণ জন্মজনপদের আদি ও অকৃত্রিম জল, হাওয়া, মৃত্তিকা, নিসর্গ ও প্রকৃতি বর্ণিলতা তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট ও জন্মভূমি-সংশ্লিষ্ট করে। ফলে তিনি পরিণত হয় একজন সুকোমল, মানবদরদী, সৎ ও পরিশ্রমী মানবসত্তায়।

মা, মাটি আর মানুষের কাছ থেকে পাওয়া চৈতন্যে আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শুরু করেন। বিশেষত বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামের সংবাদপত্রসহ শিল্পখাতে তিনি ঐতিহাসিক ও অভুতপূর্ব অবদান রাখেন। ১৯৮৬ সালে তিনি আধুনিক সংবাদপত্র ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ প্রকাশ করেন, যা ছিল বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের অগ্রসরতম ও নান্দনিক দৃষ্টান্ত।

প্রকাশনা, বিপণন, সংবাদপত্র তাঁকে ঘিরে এক নতুন ও উচ্চতর মাত্রা লাভ করে। বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও প্রকাশনাকে সর্বাধুনিক, পেশাগত, শিল্পকাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়নেও তিনি এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ। কিন্তু এই কর্মবীর এখানেই থেমে থাকেননি। রচনা করেন কর্ম ও সৃষ্টির নব-নব অধ্যায়। আর তাঁর প্রতিটি কর্মপ্রয়াসের পেছনে নিছক বাণিজ্যিক অভিলাষই ছিল না, ছিল মানবপ্রেম, জনকল্যাণ আর চট্টলার প্রতি সীমাহীন দরদের বহিঃপ্রকাশ।
১৯৯২ সাল থেকেই ডেইরি ও পোল্ট্রিশিল্পের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের আমৃত্যু সভাপতিও ছিলেন। তাঁর কর্মউদ্যোগের ফলে চট্টগ্রামে সুফল পায় প্রায় চারশ খামার। চট্টগ্রামে প্রথম গবাদি পশু মেলারও উদ্যোক্তা তিনি। ডেইরি শিল্পের বিকাশে চট্টগ্রামে প্রথম তাঁর নেতৃত্বে রুগ্ন গরু নিয়ে মিছিল হয়।
সাংস্কৃতিক জীবনের পুনরুজ্জীবনের কান্ডারী ছিলেন তিনি ঐতিহ্যমন্ডিত চট্টল জনপদে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমনস্থল নিজ বাড়িতে কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা, নজরুল মেলা এবং নজরুল পাঠাগারও স্থাপন করেন তিনি। আর এই ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করাও প্রয়োজন যে, তাঁর এমন মহতী কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পেরে আমি নিজেও ধন্য ও ঋদ্ধ হয়েছি। একাধিক বার, একাধিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি রাউজানের সেই মহত্তম ভূমিতে, যেখানে জাতীয় কবির আগমন ঘটেছিল এবং জন্ম নিয়েছিলেন ‘চট্টলদরদী’ আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। আমি আরো স্মরণ করছি, আমারই মতো ড. মনিরুজ্জামান, নাসিরুউদ্দিন চৌধুরী, কবি স্বপন দত্ত, কবি এজাজ ইউসুফী ও আরো অনেককে, যারা ‘চট্টলদরদী’র আহ্বানে সমবেত হয়েছিলেন।

সংবাদপত্র, প্রকাশনা, শিল্পায়ন, সাংস্কৃতিক জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা। চট্টগ্রাম বিআইটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ধারাবাহিক সংগ্রামেও ছিলেন অগ্রণী। তিনি সবসময় চট্টগ্রামের উন্নয়নে সোচ্চার ছিলেন। কৃষিসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে তিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন। ডেইরি শিল্প বিকাশে তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে গড়ে উঠে আন্দোলন। ভেটেরিনারি কলেজ ও পরবর্তীতে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
‘চট্টলদরদী’ আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শত আলোকের বিভায় উদ্ভাসিত হয় এক অনন্য মৃত্যুহীন প্রাণের, যিনি স্বর্ণোজ্জ্বল কর্মের বর্ণিলতায় সমগ্র চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামবাসীকে নিত্য প্রাণিত করছেন এবং জন্মশতবার্ষিকীর পটভূমিতে শোনাচ্ছেন উন্নয়ন, নির্মাণ, সুসংস্কৃতি ও জাগৃতির প্রাণময় সঙ্গীত।

লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি-কথাশিল্পী-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট