চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ৪:০৬ অপরাহ্ণ

প্রীতিলতার প্রীতিময় চট্টগ্রাম, সূর্যসেনের সূর্যালোকিত চট্টগ্রাম। বিপ্লবের চট্টগ্রাম, আন্দোলনের চট্টগ্রাম, উন্নয়নের চট্টগ্রাম, প্রকৃতির চট্টগ্রাম। বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের রাউজানের ঢেউয়া হাজী বাড়ির সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। ব্রিটিশ ভারতের উত্তাল উর্বর সময়ে তাঁর জন্ম। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্ত্রীর নাম জহুরা বেগম। তাঁদের তিন পুত্র জসিম উদ্দিন চৌধুরী, তসলিমউদ্দিন চৌধুরী এবং ডাক্তার রমিজউদ্দিন চৌধুরী। রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা। এই গ্রাম ব্রিটিশ ভারতে কবি নজরুলের পায়ের ধুলিধন্য, ঐতিহাসিক ভাবে সুপরিচিত। কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য, স্মৃতি বিজড়িত এই গ্রাম। স্মৃতি মানুষকে কীর্তিমান করে। মৃত্যুকে পিছনে ফেলে দেয়। মানুষের কর্মই মানুষকে কীর্তিমান করে। মহিমান্বিত করে। ইতিহাসে, সমাজে, উজ্জ্বল, অমলিন রাখে। মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী এমনই একজন মানুষ, একটি ব্যক্তিত্ব, একটি ইতিহাস।
পঞ্চাশের দশকে এই কীর্তিমান মানুষটির কঠোর পরিশ্রম, উর্বর দূরদর্শী চিন্তা ও চেতনা, সৃষ্টিশীল কর্ম তাঁকে কীর্তিমান করেছে, সমাজকে করেছে সমৃদ্ধ ও মহিমান্বিত এবং একটি দেশকে করেছে সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ ভারত থেকেই চট্টগ্রাম সব সময় এগিয়ে থেকেছে। অগ্রসরমান চট্টগ্রামেরই চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির স্থায়ী পরিষদের সাবেক সভাপতি জনাব ইউসুফ চৌধুরী। আমরা তাঁর ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছি।
মরহুম ইউসুফ চৌধুরী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের অগ্রদূত। ১৯৪৫ সালে সামান্য পুঁজি নিয়ে তিনি পুস্তকের ব্যবসা শুরু করেন। তখনকার বাঙালি মুসলিম সমাজে শিক্ষার হার ছিল খুবই সামান্য। সমাজকে এগিয়ে নেয়ার মানসে মানুষকে সচেতন করার তাগিদে তাঁর দূরদর্শী যে চেতনা, তারই প্রকাশ আজকের সমৃদ্ধ দেশ, সমাজ। কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ- তিতিক্ষা, অধ্যবসায় তাঁকে সাফল্যের চূড়ায় তুলে নিয়ে আসে। শিক্ষার প্রতি তাঁর নিবিড় অনুরাগ, তাঁকে পরবর্তীতে সমাজ উন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় নিয়ে আসে। প্রেস, প্রকাশনা, মুদ্রণশিল্পে তার বিচরণ সমাজকে অন্ধকারমুক্ত করার তাগিদ থেকে। দীর্ঘদিনের অধ্যবসায় একাগ্রতা শ্রম ও প্রচেষ্টা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁকে ওষুধশিল্পসহ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি নিউজপ্রিন্ট প্রভৃতির সাথে সম্পৃক্ত করে। তিনি পৃথিবীর নামি-দামি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের এজেন্ট ছিলেন। তিনি পেঙ্গুইন ও পেলিকান প্রকাশিত পেপারব্যাক বইপত্র আমদানি শুরু করেন। মানুষকে জাগানোর এটি ছিল অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম বাঙালিদের পিছিয়ে পড়ার প্রক্রিয়া তাঁকে দারুণভাবে আঘাত করে। তিনি সেই ব্রিটিশ ভারতের শেষ সময়গুলোতে সমাজ সচেতনতামূলক কাজ, পাঠ ও প্রকাশনার দিকে নিবিষ্ট হন এবং মানুষকে আকৃষ্ট করতে থাকেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ প্রক্রিয়া থেকে বাঙালি সমাজকে সচেতন করতে তিনি প্রকাশনার ব্যবসাকেই গুরুত্বের সাথে ধারণ করেন। অগ্রসর চিন্তার সাধক এই শিল্পপতি, সমাজ বিনির্মাণের একজন দক্ষ শিল্পী। এই শিল্পী, শিল্পপতি তাঁর সৃষ্টি অনুরাগে সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। শোষক পাকিস্তান সময়ে এটি ছিল তাঁর অত্যন্ত দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা এবং ভাবনার বিশেষ একটি অংশ।
পাকিস্তানের শুরুর দিকের এই কর্মকা- তাঁর নিবিড় দেশাত্মবোধের পরিচয় বহন করে। ১৯৫৪ সাল। আর ধাপে ধাপে তিনি সৃষ্টিশীল আধুনিক মুদ্রণ ও সংবাদশিল্পের কারিগর বনে যান। অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৩ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তৃতীয় বারের মতো সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে চট্টগ্রামে আসেন। কবি নজরুল ইউসুফ চৌধুরীর বাড়িতে দুইদিন অবস্থান করেন এবং এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। কবিগান ও আবৃত্তির এই ঐতিহাসিক সম্মেলন রাউজানের হাজী বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক এই হাজী বাড়িতেই মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর জন্ম। ১৯৪৩ সালে তিনি সফলভাবে তখনকার প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সূর্যসেনের সূর্যালোকিত উর্বর চট্টগ্রামে মাটি তাঁকে পাকিস্তান আন্দোলনের সেই সময়গুলোতে উত্তাল আন্দোলনের হাতছানি দেয়। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম তরুণ সমর্থক যোদ্ধা হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
রাউজান ছিল তখনকার দিনে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত উর্বর। সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত প্রাগ্রসর। সামাজিকভাবে অত্যন্ত সচেতন। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব মোহাম্মদ খালেদ এই কীর্তিমান গ্রামেরই সূর্যসন্তান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যে কতিপয় ব্যক্তি চিন্তায়-চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতি, এবং বাঙালি মুসলিম সমাজকে নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন, সক্রিয় থেকেছেন, কাজ করেছেন, জনাব ইউসুফ চৌধুরী তাদের অন্যতম।
ব্যবসার উদ্যোগ, শিল্প প্রতিষ্ঠা ও সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে এগিয়ে নেয়ার সামাজিক কর্মকা- জনাব চৌধুরীকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে মানবদরদী হিসেবে, সমাজ সংস্কারক হিসেবে এবং সমাজের সচেতন ব্যক্তি হিসেবে। সংকটে, সংশয়ে, আর্থিক অনটনে, অঘটনে তিনি কখনও উদ্যম-উৎসাহ হারাননি। সকল প্রকার বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার যে সফল মানুষটি, তারই নাম জনাব মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী।
আরো পিছনে গেলে আমরা জানতে পারি, অতি সামান্য পুঁজি নিয়ে একেবারে মাটির কাঁচা ঘর থেকে তাঁর ব্যবসায় উদ্যোগের যাত্রা শুরু। মনোহারী দোকান দিয়ে এবং পর্যায়ক্রমে তিনি দেশি-বিদেশি পত্রিকার এজেন্সি নিয়ে, সামান্য মাসিক ভাড়ায় নিউজপ্রিন্ট প্রতিষ্ঠিত সামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করে, উদ্যম ও উৎসাহ নিয়ে তিনি সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬০ সালে সামান্য টাকায় বিদেশ থেকে প্রিন্টিং এবং কাটিং মেশিন এনে নতুন লেখকদের বই ছাপানো, প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৬৭ সালে প্যাকেজিং ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। ১৯৬৯ সালে বুক সোসাইটি ভবন ভাড়া নিয়ে ঋণের টাকায় বিভিন্ন মেশিনারি আমদানি করে প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন ইউসুফ চৌধুরী।
এভাবেই ধাপে ধাপে প্যাকেজিং ইউনিট থেকে ১৯৮৪ সালে কোটি টাকা বিনিয়োগের বিসিক শিল্পনগরীতে সিগনেট প্রেস বক্স ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন তাঁর অদম্য যাত্রাকে সম্প্রসারিত করে। অতঃপর ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর সাধনার ফসল পূর্বকোণ কাগজটি আলোর মুখ দেখে। এই দৈনিকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিকাশে, বিস্তৃতিতে, জনসম্পৃক্ততা, জনপ্রিয়তায় ঈর্ষণীয় অবস্থানে অবস্থান করেছে। পাঠকের রুচি ও মননশীলতাকে জয় করেছে। প্রকাশে, প্রচারে এটি এই অঞ্চলে শীর্ষে অবস্থান করছে। কাগজটি এই কীর্তিমানের অনন্য কীর্তিগুলোর অন্যতম। প্রায় তিন যুগকে স্পর্শ করছে চট্টগ্রামের এই জনপ্রিয় দৈনিকটি। ১৯৯৪ সালে কাগজটি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মূল্যায়নে এই অঞ্চলের পত্রিকাসমূহের শীর্ষে উঠে আসে। মরহুম মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর দূরদর্শী নেতৃত্বে পত্রিকাটি দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়েছে। এর কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে সময়ের সাথে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রখ্যাত লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, প্রতিবেদক এবং সমাজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ। মরহুম ইউসুফ চৌধুরী অনন্য সৃষ্টি পূর্বকোণ কাগজটির একদল নিষ্ঠাবান কর্মীবাহিনী, সংবাদ সংগ্রাহক, প্রতিবেদক প্রমুখদের নিরন্তর প্রচেষ্টার পরিচয় দিয়ে চলেছে কাগজটি। তাদের যৌথ প্রচেষ্টার মেধাবী স্বাক্ষর আজকের এই পত্রিকাটি।
অত্যন্ত মেধাবী এবং দূরদর্শী এই শিল্পদ্যোক্তা, শিল্পপতি একেবারে সাধারণ অবস্থা থেকে নিজেকে শিল্পের একজন স্বপ্নচারী দক্ষ কারিগর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। একাগ্রতা, ব্যবসায়িক মেধা, পরিশ্রম, স্বপ্নকে স্পর্শ করার অদম্য বাসনা তাঁকে চট্টগ্রামের সমাজে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।
কর্মে নিষ্ঠা, সততা, ধর্মানুরাগ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা একজন ইউসুফ চৌধুরীকে প্রতিষ্ঠা করেছে সমাজ সংস্কারক এবং প্রাগ্রসর চিন্তার অগ্রদূত হিসেবে। পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা, সময় মেনে চলা প্রভৃতি কঠোর সামাজিক-পারিবারিক বিধানগুলো একজন ইউসুফ চৌধুরী ভেতর তীব্রভাবে লক্ষ্য করা যায়। নিবিড় সাহিত্যানুরাগী ছিলেন তিনি। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় জাতীয় কবি নজরুলকে স্মৃতিফলকের মাধ্যম দিয়ে রাউজানে ধরে রাখার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চট্টগ্রামের ভেটেনারি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের প্রকৌশল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরসহ একাধিক উন্নয়নমূলক ঐতিহাসিক কাজে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর বয়স কোন বাধা হয়নি ।
এই মেধাবী শিল্পপতি, সমাজ সংস্কারক, চট্টলদরদী মানুষটি ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গমন করেন। মহান স্রষ্টার অপার কৃপায় সেখানেই তিনি দেহত্যাগ করেন। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি শ্রদ্ধাভরে। চট্টগ্রামসহ এদেশের মানুষের জন্য এই কীর্তিমান মানবের অভাব পূরণ হবার নয় কোনদিন। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি আমরা। বেঁচে থাক মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের মাঝে।

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি, মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, কর্ণফুলীর গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট