মাহে রমজান ছবর ও সংযমের মাস। অভাবী দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করার মোক্ষম সময়। এ মাসে মুসলমানগণ দিবাভাগে উপবাস থাকার কারণে ফকির-মিসকীনের ক্ষুধার জ্বালা বুঝতে পারে। দিবারাত্রি কঠোর পরিশ্রম ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে ইবাদতের মাঝে এ মাস অতিবাহিত করতে হয়। ফলে মুমিন-মুসলমানরা মুটে মজুরের ক্লান্তি-শ্রান্তিময় কষ্টকর জীবনের মূল্য বুঝতে পারে। ইমাম গায্যালী বলেন, ‘‘দৈহিক কৃচ্ছতা এবং সংযমের সাথে যখন অন্তরের সাধনা যুক্ত হয়, তখনই আদর্শ সংযম চেতনা রমজানের সিয়াম সাধনায় শ্রেষ্ঠত্বে প্রতিফলিত হয়।”
রোজা আমাদেরকে ছবরের তালিম দেয়। আর সবর ব্যক্তিকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। সংসার জীবনের নানান জটিলতায় ছবরের মাঝেই রয়েছে প্রকৃত সাফল্য। সেজন্য কুরআন-হাদীসের অসংখ্য জায়গায় ছবর এখতিয়ার করার জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে।
আল কুরআনের সুরাতুল আছরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, “শপথ কালের, নিশ্চয় পৃথিবীর সকল মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে অতঃপর সৎকর্ম করে চলে, পারস্পরিক সত্য পথের উপদেশ দেয় এবং একে অপরকে ছবর এখতিয়ার করতে বলে তারা নয়।”
রমজানে গরীবের কষ্ট বুঝতে পারলে এবং ধৈর্য নামক গুণটি অর্জন করতে পারলেই সিয়াম সাধনার সার্থকতা। মহানবী (স.) বলেন, ‘‘এ রমজান ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাতের পরম সুখ।” (মিশকাত)
রমজান মাসের এ শেষ পর্যায়ে এসে সর্বস্তরের রোজাদারকে অবশ্যই জীবনের পদে পদে কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসা,মোহ-অস্থিরতা ও অহমিকাবোধ বর্জন করতে হবে। একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীলতা ও তাকওয়ার গুণ অর্জন করে সমাজ ও পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠার শপথ নিতে হবে।
যে মহান উদ্দেশ্য সাধনে আমরা এ তীব্র গরমের দিনে রোজা পালন করছি রোজার সে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রোজাদারের ইবাদতী মন থাকা প্রয়োজন। আর ইবাদত অর্থ দাসত্ব করা, গোলামী করা। ইসলামী চিন্তাবিদদের পরিভাষায় ইবাদত হল, আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর আইন ভঙ্গের অপরাধ না করা এবং যে কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় আর যতদূর সম্ভব নিজের আমিত্বকে নষ্ট করা যায়, আল্লাহকে ভালবেসে সে সব কাজ ঐকান্তিক আগ্রহের সাথে পালন করা। দিনভর খাবার ও পানীয় বর্জন রোজার বাহ্যিক দিক। যদি অবিচল বিশ্বাস ও খোদাভীরুতা না থাকে তাহলে রোজার অভ্যন্তরীণ দিক পূর্ণতা পাবে না। প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলবে রোজা। আর তাই রাসুলে খোদা (সাঃ) এরশাদ করেছেন- “মান ছা‘মা রমাদানা ঈমানান ওয়া ইহতেসাবান গুফিরা লাহু মা ত্বাকাদ্দমা মিন জনবিহি”। অর্থাৎ ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে যে ব্যক্তি রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহ-অপরাধ মাফ করে দেয়া হবে। এ হাদীসে ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে এবং সেই মানের রোজার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে ঈমান অর্থ আল্লাহ সম্পর্কে একজন মুমিনের যে ধারণা ও আকীদা হওয়া উচিত তা স্মরণ থাকা চাই আর ইহতেসাব অর্থ এই যে, মুসলমান সব সময়েই নিজেও চিন্তা- কল্পনা করবে, নিজের কাজকর্মের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে ও ভেবে দেখবে যে, আল্লাহর মর্জির বিপরীতে চলছে না তো !
হযরত নবীয়ে দো জাহান (স:) নানাভাবে রোজার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং বুঝিয়েছেন যে, উদ্দেশ্য না জেনে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত সময় কাটানোর কোন সার্থকতা নেই। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করবে না তার শুধু খানাপিনা পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই। অন্য হাদীসে মহানবী (সঃ) এরশাদ করেছেন, “অনেক রোজাদার এমন আছে কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া যার ভাগ্যে কিছুই জুটে না। তেমনি রাত্রিতে ইবাদতকারী এমন মানুষও আছে যারা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না । উল্লেখিত হাদিস দুটি দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা নিবারণে রোজা হয় না। এটা রোজার অবলম্বন মাত্র। রোজা ত্যাগ, নিষ্ঠা, সংযম, সহানুভূতি ও তাকওয়ার যে শিক্ষা দেয় তা অর্জন ও বাস্তবায়ন করতে না পারলে সে রোজা অন্তঃসারশূন্য থেকে যাবে। তা বাহ্যিক রোজা পালন হলেও আল্লাহর কাছে কবুল হবে না।
রমজান মাস প্রশিক্ষণের মাস। আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের মাস। এ মাসে মুমিন নৈতিক ও ঈমানী চরিত্র অর্জন করে বাকি এগারো মাস তা অনুসারে জীবন যাপন করবে। রমজানে মুমিন দিবা বেলায় সিয়াম ও রাতের বেলায় ক্বিয়ামে নিরলস ও বলিষ্ট চেতনা শিক্ষা লাভ করে । ক্ষুধা -তৃষ্ণায় দরিদ্রের কষ্ট বুঝার সুযোগ পায়। ইফতার ও তারাবীহ হতে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের চিত্র পরিস্ফুটিত হয়। নির্জনে নিদারুণ তৃষ্ণার পরও এক ফোঁটা পানি পান না করাতে তাকওয়ার চরিত্র অর্জিত হয়।
যে আয়াতে ক্বারীমা দ্বারা রোজা ফরজ করা হয়েছে সে আয়াতে ক্বারীমায় রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘লা-আল্লাকুম তাত্তাকুন’- রোজা এজন্য ফরজ করা হয়েছে যে, ‘যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’। তাকওয়া অর্থ-আত্মরক্ষা করা, বিরত থাকা। পরিভাষায়, শরীয়তের আদেশগুলো পালন করা এবং নিষেধসমূহ থেকে বিরত থাকার নামই তাকওয়া।
পরিশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মাসব্যাপী রোজা রাখার ফলে অর্জিত তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য অবলম্বন করে আমাদেরকে বাকি ১১ মাস চলতে হবে। তাকওয়ার উদ্দেশ্যম-িত রোজার জন্যই সকল ফজিলত ও মারতাবা। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়াভিত্তিক জীবন যাপন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।