চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অষ্টম কলাম

গুজব সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্টের ভাইরাস

হাসানুর রহমান

৪ এপ্রিল, ২০২০ | ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে, গুজব নামক ছোঁয়াছে রোগের ভাইরাসে জর্জরিত আমাদের সমাজ। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে গুজব নামক ভাইরাসটিও দিন দিন ছড়াচ্ছে মহামারীর মতোই। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হল এমন কোন বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনই নিশ্চত করা সম্ভব হয় না। ভুল, অসঙ্গত, ভিত্তিহীন, বানোয়াট তথ্যের সমন্বয়ে তৈরী হয় গুজব। সহজলভ্য, প্রযুক্তির এই যুগে গুজব ছড়াচ্ছে বাতাসের বেগে। কথায় আছে, হুজুগে বাঙালি, আসলেও তাই। সত্য-মিথ্যার বিচার বিবেচনা না করেই, আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার যেখানে যা দেখছি তাই মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি। যার দরুণ আমাদেরকেই আতঙ্ক এবং ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের অবস্থা হয়েছে এমন যে, কেউ বললো তোমার কান নিয়ে যাচ্ছে চিলে, নিজের কানে হাত দিয়ে সত্য-মিথ্যার যাচাই না করেই, আমরা চিলের পিছে কান খুঁজতে ছুটছি। আমাদের সমাজে গুজব এতো বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, এখন সত্য কোনো বিযয়ও আমাদের কাছে গুজব মনে হয়, আবার গুজবকেও সত্য বলে মনে হয়। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতেই আমাদের হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে। কিছুদিন আগেও ছেলেধরা গুজবে সারাদেশে গনপিটুনেতে নিহত হয়েছে ৮ জন। যদিও এদের কেউই ছেলেধরা ছিলনা। এক মা তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েও ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে মর্মান্তিক হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আবার লবণের স্বল্পতার গুজবে, বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেছে জনগণকে। এদিকে এই সুযোগে মুনাফালোভী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মুহূর্তেই বাড়িয়ে দিয়েছে লবণের দাম। মানে সব মিলিয়ে এক হুলুস্থুল অবস্থা হয়েছে পুরো জাতির। আর এর জন্য দায়ীও গুজব রটনাকারী এবং আমাদের অসচেতনতা। সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইনে গুজব ছড়ানো একটি জামিন অযোগ্য সাইবার অপরাধ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৭ এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তা হলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ যদি কেউ উক্ত কোনো সাইবার অপরাধ করে তাহলে তার জন্য ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। অপরাধ প্রমাণিত হলে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৭ (দুই) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করে তাহলে তার শাস্তি সবোর্চ্চ ১৪ বছর কারাদ- এবং সবির্নম্ন ৭ বছর কারাদ- এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে দন্ডিত হবেন। এছাড়াও ইসলামী শরীয়তে গুজব ছড়ানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কোনো খবর দেখলেই যাচাই-বাছাই করা ছাড়া তা বিশ্বাস করা অনুচিত। পবিত্র কোরআনে ভুল তথ্য অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করোনা। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬) হাদিসের মধ্যে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ভিত্তিহীন গুজব প্রচার করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, একজন মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, যা শুনবে, তা-ই বলে বেড়াবে।-(মুসলিম)। ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে মিথ্যা, গুজব পোস্ট করা এবং তা শেয়ার করে ছড়ানো যেমন কবিরা গুনাহ, তেমনি কোনো নির্দোষ লোককে বিপদে ফেলতে বা তার সম্মানহানি করতে তার নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সে আইডি থেকে সমাজবিরোধী পোস্ট করাও মারাত্মক কবিরা গুনাহ এবং অন্যায়। তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদের সকল প্রকার গুজব থেকে সচেতন হতে হবে। বর্তমানে করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বে এক মহামারীতে রূপ লাভ করেছেন। আর এই করোনা ভাইরাস নিয়েও ফেসবুকে বিভিন্ন রকম গুজব ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। নাগরিক হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হলো গুজবে কান না দেওয়া এবং সকল প্রকার গুজব সম্পর্কে নিজের পরিবার এবং সমাজকে সচেতন করে গড়ে তোলা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট