চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সিটি নির্বাচন ঘিরে কিছু প্রস্তাবনা

অনলাইন ডেস্ক

২২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৬:৩৬ অপরাহ্ণ

নগরাঞ্চলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হয় মূলত স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ অনুসারে। দার্শনিক ও তাত্ত্বিক দিক বিচারে আমাদের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় একটি ত্রুটিপূর্ণ দিক রয়েছে। তা হলো স্থানীয় সরকারের প্রধান হিসেবে আমরা সরাসরি মেয়র নির্বাচিত করি; যা স্থানীয় সরকারের কর্মপন্থা ও চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ আমাদের নির্বাচন করার কথা স্থানীয় সরকারের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে যে দল বেশিসংখ্যক আসন পাবে, তারাই নির্বাচন করবে তাদের মেয়র কে হবে। যেমন করে এমপিরা নির্বাচন করেন সরকারপ্রধান কে হবেন। যার ভালো দিক হচ্ছে, এলাকার মানুষ যাকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত করবে, তিনি সরাসরি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। মানুষ সহজে এলাকার সমস্যা কাউন্সিলরকে জানাতে পারবে। তাছাড়া মেয়র অনেক দূরে কোথাও বসেন। এতগুলো ওয়ার্ডের দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষ সহজে মেয়রের কাছে পৌঁছতে পারে না। ফলে সাধারণ মানুষ আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব-অভিযোগ ও দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, তা বলার জন্য কাউকে কাছে পায় না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগের মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের দায়দায়িত্ব এবং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের কাছ থেকে নাগরিক হিসেবে কী আশা করা যেতে পারে, সে বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন।

গণমানুষের প্রতিনিধি: আমরা যে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচন করি, বর্তমানে তারা তাদের কর্মপরিধি অনুযায়ী খুব বেশি গুরুত্ব বহন করেন না। নামমাত্র অল্প কিছু কাজ করেন তারা। অথচ স্থানীয় সরকার আইন বাস্তবায়নের জন্য তারাও সমান দায়বদ্ধ। স্থানীয় সরকার আইনের ৪১ নং অনুচ্ছেদের অধীনে তৃতীয় তফসিলে মোটাদাগে ২৮টি কাজ আছে, যার মধ্যে আবার বিস্তারিতভাবে অনেক কিছু বলা আছে। ওই একই কাজ কিন্তু তাদেরও করার কথা। আমার মনে হয়, তাদের দায়দায়িত্ব বাড়ানো দরকার। স্থানীয় সরকারের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ওয়ার্ড কাউন্সিলরকেন্দ্রিক হওয়া উচিত। এতে এলাকার মানুষের ভেতর নিজের এলাকার উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার এবং অংশগ্রহণের আগ্রহ জন্মাবে। স্থানীয় মানুষজন জানবে যে তার যেকোনো কাজের জন্য এলাকার কাউন্সিলরের অফিসেই যেতে হবে এবং ওখানে গেলে কী ধরনের সেবা সে পাবে। এলাকার মানুষের সঙ্গে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও অফিসের সরাসরি যোগাযোগ হবে। আমরা প্রায়ই এলাকায় মশা নিধন, জলাবদ্ধতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রসঙ্গে জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততার কথা বলে থাকি। কিন্তু জনসম্পৃক্ততা বা গণসংযোগ কখন তৈরি হবে? যখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের যোগাযোগ তৈরি হবে। এভাবে সব কর্মকাণ্ডে ওয়ার্ড কাউন্সিলর জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেন। এ কারণে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার বিষয়ে আমি জোর দিই।

আমরা যাদের নির্বাচিত করছি, তারা আসলে জনপ্রতিনিধি। ঢাকা শহরে দুজন মেয়র নির্বাচিত হবেন। উত্তরের মেয়র ৩৩ লাখ ভোটারের ভোটে নির্বাচিত হবেন (অনেক সময় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ২ থেকে ৩ লাখ ভোটারও থাকেন)। সেদিক থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে এ শহরে যিনি মেয়র নির্বাচিত হন, তিনি প্রচুরসংখ্যক মানুষের ভোটে নির্বাচিত হন। তিনি একজন সত্যিকারের গণমানুষের প্রতিনিধি। তাই তার নগর পরিকল্পনা হতে হবে গণমুখী বা মানুষকেন্দ্রিক। এটা মানুষকেন্দ্রিক যখন হবে তখন আমরা এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় যেমন বলি, ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে উন্নয়ন’, সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে।

পূর্ণাঙ্গ ওয়ার্ড কমপ্লেক্স: সারা ঢাকা শহরে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস সাধারণত ছোট একটা জায়গার মধ্যে অবস্থিত, অনাকর্ষণীয় কোনো একটা বিল্ডিংয়ে, যা খুব একটা দৃশ্যমানও নয়। সিটি করপোরেশনের সব ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের অফিসগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স তৈরির বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় আনতে হবে। সিটি করপোরেশন যেসব নাগরিক সুবিধা প্রদান করে, তা এ কমপ্লেক্স থেকে পরিচালিত হতে পারে। একটি কমিউনিটি সেন্টার ও লাইব্রেরি থাকতে পারে। অথবা সিটি করপোরেশন ছাড়াও অন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিক সুবিধা দিয়ে থাকে, যেমন নগর স্বাস্থ্যসেবা, ওয়াসা, বিদ্যুৎ ইত্যাদির একটা করে ছোট অফিস ওই কমপ্লেক্সে থাকতে পারে। তাহলে নির্দিষ্ট একটা জায়গা থেকে অনেক সেবা দেয়া সম্ভব হবে। এভাবে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসটা মানুষের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে পরিণত হবে। এলাকা-মহল্লার রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি কাজ আছে, তা সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাবে।

গণপরিসর: আমরা কোনো না কোনোভাবে আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরকে সুন্দর করে সাজানোর ব্যবস্থা করে ফেলি, এর যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করি। নিজের ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরে যখন আমরা যাই, তা হচ্ছে গণপরিসর। পার্ক, রাস্তাঘাট, ফুটপাত থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, গণজমায়েতের স্থান—এ সবকিছুই গণপরিসর। ব্যক্তিমানুষ কখনো এর দেখভাল করে না। কিছু সংস্থার কাছে দেখভালের দায়িত্ব দেয়া থাকে। কখনো সিটি করপোরেশন, কখনো রাজউক থাকে। তবে বেশির ভাগ কাজই সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত থাকে। যে শহর যত বেশি ভালোভাবে তার গণপরিসর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা করতে পেরেছে সে শহর তত বেশি সফল হয়েছে। পৃথিবীতে যত উন্নত ও আধুনিক শহর আমরা দেখি, সেখানে প্রতিটি গণপরিসরকে অনেক ভালোভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। ইউরোপের শহরে গণপরিসরগুলোকে এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যেন মানুষ এগুলো বেশি করে ব্যবহার করে। ফলে ওই শহরের মানুষ নিজেদের বাসার চেয়ে বাইরে বেশি সময় কাটায়। আমাদের গণপরিসরগুলো সাজানো খুব প্রয়োজন। আমাদের দর্শন যদি হয় জনমুখী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, তাহলে গণপরিস এভাবে তৈরি করতে হবে যেন মানুষ এগুলো ব্যবহার করে আরাম পায়। তাই একটা ভালো শহর তৈরি করতে খেলার মাঠ, উদ্যান, লেক, রাস্তাঘাট, ফুটপাতসহ সব গণপরিসরের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে।

আমাদের শহরে অনেক সময় ভালো সুপরিসর নিরাপদ ফুটপাত থাকে না। কখনোবা হকারের দখলে থাকে, কখনোবা অন্য কোনোভাবে দখল হয়ে থাকে। অথচ নিরাপদ ফুটপাত নগরকে প্রাণবন্ত করে। যেখানে বড়জোড় ১০ জন হকার দাঁড়ানোর সুযোগ আছে, সেখানে ২০০ জন হকার দাঁড়ায়, ফলে সেখানে হকারদের ভিড়ে হাঁটা যায় না। একটি শহরে হকারদেরও প্রয়োজন রয়েছে। তাই নিবন্ধিত করার মাধ্যমে হকারদের সংখ্যা ও স্থান নির্দিষ্ট করে দেয়া সম্ভব কে কোন জায়গাটায় অবস্থান করবে। বড় শহরগুলোয় হকারদের নিবন্ধন করে কিছু জায়গায় তাদের বসার অনুমতি দেয়া হয়, যাতে পথচারী বা অন্য মানুষের চলাচলে কোনো বাধা তৈরি না হয়। ভেন্ডর পলিসি তৈরি করা যেতে পারে। দিল্লিতে যেমন ভেন্ডর পলিসি রয়েছে। কোন রাস্তায় কতজন হকার দাঁড়াতে পারবে, তারা কী ধরনের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করবে এবং কীভাবে প্রদর্শন করবে, তার জন্য নকশা করা আছে। তাছাড়া নিবন্ধিত হওয়ার সময় হকাররা সিটি করপোরেশনকে একটা ফি প্রদান করবে। আবার প্রতি বছর নবায়ন বাবদও একটা ফি নেয়া হবে। এভাবে হকারদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করাটা খুব জরুরি।

দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে রাস্তার ইন্টারসেকশনগুলোয় আন্ডারপাস তৈরি করে রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবস্থা ও হকার পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ছোট ছোট দোকানের মাধ্যমে হকারদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। রাস্তার উপরে বা ফুটপাতে তাদের দেখা যায় না। একেকটি শহর কিন্তু একেকভাবে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করেছে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে আমরা যা-ই করি না কেন, তা যেন আমাদের শহরের মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর ও স্থানিকভাবে অর্থ বরাদ্দ: সবসময় আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক শহরের কথা বলি। বিশেষ দু-একটা অঞ্চলের উন্নতি নয়, আমাদের সব অঞ্চলকে নিয়ে ভাবা দরকার। সে কারণে সিটি বাজেট যখন তৈরি করা হয়, তাতে যেন স্থানিকভাবে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়। আমাদের বাজেট বরাদ্দের যে প্রক্রিয়া, তা স্থানীয় সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট, সব জায়গাতেই খাতভিত্তিক বাজেট বরাদ্দের কথা বলা হয়। স্থানিকভাবে অর্থের বরাদ্দ করা হয় না। অঞ্চলভেদে যদি বাজেট বরাদ্দ করা হয়, তবে দুর্বল বা অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত অঞ্চলগুলো তাদের জন্য বেশি বাজেট বরাদ্দের দাবি করতে পারবে। তাদের নিয়ে আমরা একসঙ্গে এগোতে পারব।

ওয়ার্ড প্রোফাইলিং: প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখতে চাই, আগামী সিটি নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তারা প্রত্যেকটা ওয়ার্ডের প্রোফাইলিং করবেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের চাহিদা নিরূপণ করবেন। প্রত্যেক ওয়ার্ডের চাহিদা কিন্তু একই রকম হবে না। কোথাও বেশি দরিদ্র মানুষের বসবাস, কোনো অঞ্চলে অবকাঠামোর বেশি খারাপ অবস্থা, কোথাও আবার অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থা। চাহিদা নিরূপণ করে প্রতিটি ওয়ার্ডের অবস্থা যাচাই করতে হবে। এটি নতুন কোনো ধারণা নয়। এর ফলে সিটি করপোরেশনের মেয়র বা কাউন্সিলর যারা হবেন, পরবর্তীতে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে এবং পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করাও সহজ হবে। আনিসুল হক যখন মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন তখন কিন্তু কাজের মান হঠাৎ করে অনেক ভালো হয়ে গিয়েছিল। কারণ তিনি নানা পরিকল্পনা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে একটা জায়গায় আসতে পেরেছিলেন। যেমন রাতে কাজ করা, জনদুর্ভোগ কমানো, মানসম্পন্নভাবে অথচ কম সময়ের মধ্যে রাস্তা ও ড্রেনগুলোর সংস্কারকাজ সম্পন্ন করেছিলেন। তার সময় যতটা তদারকি-তত্পরতা আমাদের চোখে পড়েছিল, পরবর্তীতে ততটা দেখা যায়নি। আমার মনে হয়, এ জায়গাটা কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে, একে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কাজগুলোর ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন। নিয়মিত ভালো তদারকি ছাড়া কাজের মান অর্জন সম্ভব নয়। কাজের মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক গবেষণা। এটা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

জনদুর্ভোগ ও তদারকি দল গঠন: আমরা প্রায়ই জনদুর্ভোগের কথা বলি। আমরা দেখি অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে রাস্তাঘাট দখল হয়ে যায়। ফুটপাতগুলো দখল হয়ে যায়। হকারদের কেনাবেচা চলে। ইট, সিমেন্টের মতো নির্মাণসামগ্রী ফেলা রাখা হয়। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা তৈরি হলে সপ্তাহ ধরে সে অবস্থা চলতে থাকে। কোথাও আবর্জনা পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে, কেউ হয়তো খেয়ালও করছে না। এ অবস্থায় তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপার আছে। স্থানীয়ভাবে জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া শুধু অ্যাপস দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এজন্য স্থানীয়ভাবে একটা তদারকি দল তৈরি করা প্রয়োজন। রাজউকের যেমন প্রত্যেক অঞ্চলভেদে বিল্ডিং ইন্সপেক্টর রয়েছে, সিটি করপোরেশনেরও এমন অঞ্চলভেদে তদারকি দল থাকা প্রয়োজন, যার নেতৃত্ব দেবেন ওয়ার্ড কমিশনার। তার সঙ্গে ওই ওয়ার্ডের বিভিন্ন রকম সংগঠন, যেমন ক্রীড়া সংগঠন, এনজিও, পরিবেশবাদী সংগঠন তাদের সঙ্গে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মালিক সমিতির লোকদের সমন্বয়ে ওই তদারকি দল গঠন করা যেতে পারে। এ তদারকি কমিটির কাজ হবে ওই এলাকায় যেসব কাজের জন্য জনদুর্ভোগ তৈরি হয় বা মানুষের অসুবিধা হয়, সেগুলোকে তাত্ক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করা। এ কমিটির মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, উন্নয়নকাজে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা যাবে। মাদকের সমস্যা, জননিরাপত্তা, জনদুর্ভোগ, এলাকার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তাই আমি মনে করি, তদারকি দল গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া উচিত।

অনলাইন ট্যাক্স ব্যবস্থা: বর্তমানে আমাদের কর প্রদানের যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে প্রতিটি টেবিলে টেবিলে ঘুরে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে কর জমা দিতে হয়। কিন্তু অনলাইন কর প্রদানের ব্যবস্থা চালু করা হলে মানুষ সহজে কর দিতে পারবে। আর এটা করা কঠিন কিছু নয়। এতে মানুষের দুর্ভোগ কমে আসবে এবং ভালো হবে বলেই আমি মনে করি।

সম্পত্তির মানচিত্রের হালনাগাদকরণ: বর্তমানে সম্পত্তি মানচিত্র হালনাগাদ করাটা ভীষণ জরুরি। এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরনো ম্যাপ ও পুরনো রেকর্ডের ভিত্তিতেই সম্পত্তি কর নির্ধারণ করা হয়। ফলে যে জায়গায় আগে দোতলা বাড়ি ছিল, সেখানে এখন পাঁচতলা কিংবা ১০ তলা বাড়ি হয়েছে। এখান থেকে যে আয়টা হয়, তা আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে গেছে। সে তুলনায় সিটি করপোরেশন কিন্তু কর পায় না। সিটি করপোরেশনকে তার ন্যায্য কর পাওয়ার জন্য অনলাইন ট্যাক্স পদ্ধতি প্রচলনের পাশাপাশি সম্পত্তির মানচিত্রের হালনাগাদে মনোযোগী হতে হবে এবং প্রতি তিন-চার বছর পর মানচিত্রটি হালনাগাদ করতে হবে। তাহলে সিটি করপোরেশন তার ন্যায্য করটা আদায় করতে পারবে। করের প্রবাহ যতক্ষণ শক্তিশালী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি ভালো সেবাও আশা করতে পারেন না। আর ততদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে যে কখন থোক বরাদ্দ আসবে। যে মেয়র বা যে জনপ্রতিনিধির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, তিনি হয়তো ভালো একটা আর্থিক বন্দোবস্ত করতে পারেন। অন্যরা হয়তো পারেন না। ব্যবস্থাটি কিন্তু এমন হওয়ারই কথা নয়। সিটি করপোরেশন কর পাবে এবং করের বিনিময়ে সেবা দেবে—ব্যবস্থাটি এমন হওয়ার কথা।

দখলমুক্ত করা: বিভিন্ন স্থানকে দখলমুক্ত করার বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের দেশে জনসম্পত্তি বিভিন্নভাবে দখলের শিকার হয়। সিটি করপোরেশনকে দেখভাল করতে হবে যে কেউ কোথাও এর দখল নিয়ে যেন সুবিধা নিতে না পারে। তা ফুটপাত, বাজার, ভবন কিংবা রাস্তাঘাটই হোক। কোথাও সরকারি সম্পত্তি দেখলেই প্রভাবশালীরা তা দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে যায়। তারা কখনো আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান। কখনো প্রশাসনিক বা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। সুতরাং এ ধরনের ক্ষমতাবানদের দখল থেকে গণপরিসর ও সরকারি সম্পত্তিকে দখলমুক্ত করতে কারো প্রতি অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। শহরের ফুটপাত, রাস্তাঘাট, পার্কগুলোকে যদি দখলমুক্ত না করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ শহরের মধ্যে চলাফেলা করে কখনো স্বস্তি পাবে না। তাই দখল মুক্ত করা খুব প্রয়োজন।

জলাবদ্ধতা ও যানজট: জলাবদ্ধতা, যানজটসহ এ ধরনের আরো কিছু বিষয় আছে, যেগুলো যৌথ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার। কয়েকটা প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকারের এখানে কিছু করার নেই। এখানে আসলে স্থানীয় সরকারকেই নেতৃত্বের ভূমিকায় যেতে হবে।

২০১৭ সালের ১৬ জুলাই তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকের অফিসে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জলাবদ্ধতাবিষয়ক একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে জলাবদ্ধতা বিষয়ে যতগুলো সরকারি সংস্থা কাজ করুক না কেন, এখানে নেতৃত্ব দেবে সিটি করপোরেশনের মেয়র। মেয়রের নেতৃত্বেই ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজটা হবে এবং তিনিই ওয়াসা, ডিসি অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজ করবেন। কিন্তু নেতৃত্ব থাকবে সিটি করপোরেশনের মেয়র। সে জায়গাটায় আমরা এখনো দৃঢ় আছি। আমরা মনে করি, যানজট সমস্যা কিংবা জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে নেতৃত্বের জায়গাটা মেয়রদেরই নেয়া উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত ভালো নেতৃত্ব তৈরি না হবে ততক্ষণ এ ধরনের বহু সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত যে ইস্যুগুলো আছে, তা সমাধান হওয়ার নয়। কাউকে না কাউকে কিন্তু নেতৃত্ব নিতে হবে। আমরা দেখেছিলাম আনিসুল হক নেতৃত্বের জায়গাটা নিয়েছিলেন। তিনি অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য তিনি কাজটা শেষ করে যেতে পারেননি।

স্থায়ী কমিটির কাজের পুনর্বিন্যাস: স্থানীয় সরকার আইনের মধ্যে ১৪টা স্থায়ী কমিটির কথা বলা আছে। এ কমিটিগুলোর মাধ্যমে সিটি করপোরেশন তার সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে। এদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন যে কেন স্থায়ী কমিটিগুলো কার্যকর নয়। কী কী কারণে কমিটিগুলো সচল করা যায় না। কমিটিগুলো সচল করা প্রয়োজন। তাদের জবাবদিহিতা প্রয়োজন। তারা যে কাজগুলো করে, তা যেন প্রতিনিয়ত সভার মাধ্যমে প্রতিবেদন হিসেবে সিটি করপোরেশনের কাছে তুলে ধরা হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আইনে ১৪টা স্থায়ী কমিটির কথা আছে, প্রয়োজনে আরো বাড়ানো যেতে পারে।

নগর দরিদ্র ও বস্তি: উল্লিখিত বিষয় দুটি নিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় যতটা কথা হওয়া উচিত, তেমনটা হয় না। অথচ ঢাকা শহরের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষই বস্তিতে বসবাস করে। সরকারি হিসাব যদিও এটা মানতে চায় না। বস্তিবাসীরা মানসম্পন্ন আবাসনের মধ্যে থাকে না। নগরের নাগরিক হিসেবে তাদের সুপেয় পানি সরবরাহ, পানি নিষ্কাশন থেকে শুরু করে অন্যান্য পরিষেবা সরবরাহের কথা। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ আনুযায়ী এসব পরিষেবা পাওয়ার অধিকার তাদের আছে। অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শহরের একটা বিরাট অংশজুড়ে বস্তির জনগোষ্ঠী যুক্ত। এ জনগোষ্ঠী ছাড়া ঢাকা শহরটা কিন্তু অচল হয়ে যাবে। সুতরাং এদের যথাযথভাবে দেখার প্রয়োজন আছে। কিছুদিন পরপর বস্তিতে আগুন লাগা অথবা বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়গুলোয় করপোরেশনকে দায়িত্ব নিতে হবে। বস্তির লোকেরা শুধু যেন ভোটার হয়ে বেঁচে না থাকে, বরং তারা যেন তাদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। অনেকে বলেন, নিম্নবিত্তদের জন্য এসব ব্যবস্থা নিলে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হবে। সারা দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্য সামনে রেখে প্রতিটি বিভাগ ও জেলায় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিশ্চিত করতে পারলে ঢাকার ওপর আর এত চাপ পড়বে না। তাছাড়া আমরা দেশের অন্য শহরগুলোকেও যদি সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন করি তাহলে ঢাকার ওপর চাপ কমে যাবে।

নতুন উন্মুক্ত স্থান সৃষ্টি করা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নগরে জনপ্রতি নয় বর্গমিটার খোলা জায়গা থাকা প্রয়োজন। এ শহরে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র নব্বই ভাগের এক ভাগ উন্মুক্ত স্থান আছে। নির্বাচিত ১১১ জন কাউন্সিলর তার ওয়ার্ডে একটি করে নতুন উন্মুক্ত স্থান (খেলার মাঠ/পার্ক) সৃষ্টি করতে পারে। পাঁচ বছর পর ঢাকা শহরের জনগণ নতুন শতাধিক উন্মুক্ত স্থান পেয়ে যাবে। জায়গা প্রাপ্তিসাপেক্ষে এসব উন্মুক্ত স্থান ছোট-বড় নানা সাইজের হতে পারে। সিটি করপোরেশনের প্রয়োজনে জমি কিনে হলেও এ ধরনের উন্মুক্ত স্থান সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্রে বণিক বার্তা

পূর্বকোণ/-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট