চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কৃষকের কান্না, মিল মালিকের হাসি

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৯ মে, ২০১৯ | ৩:০৯ পূর্বাহ্ণ

পাইকারি বাজারে আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে ২৮ টাকা দরে। আর সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। সরকার আতপ চাল ৩৫ টাকা ও সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা দরে কিনছে মিল মালিকদের কাছ থেকে। বাজারমূল্য আর সরকারি ক্রয়মূল্যে প্রতিকেজি ৭ টাকা থেকে ৬ টাকা ফারাক। এতে মিল মালিকদের পেয়াবারো অবস্থা। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচিতে চাল দিতে মহানগর ও জেলার ১৪৭ মিল মালিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। চালের দাম বাড়তি থাকায় মিল মালিকেরা খুশি থাকলে ধানের ন্যায্য দর না পাওয়ায় কাঁদছে কৃষক। ফড়িয়া ও দালালরা কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি ধান কিনছে ১৩ থেকে ১৪ টাকা দরে। অথচ প্রতিকেজি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে প্রায় ২২-২৪ টাকা।

প্রতি বোরো মৌসুমে নতুন ধান গোলায় তোলার পর ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচি শুরু করে সরকার। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে এই কর্মসূচি।

খাদ্য বিভাগ জানায়, চট্টগ্রামে এবার ১৪ হাজার ৬৩৮ মে. টন চাল সংগ্রহ করবে সরকার। এরমধ্যে আতপ চাল হচ্ছে ১০ হাজার ৭১১ মে. টন। সিদ্ধ চাল হচ্ছে তিন হাজার ৯২৭ মে. টন। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার রাইস মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করবে সরকার। ইতিমধ্যে আতপ চাল বিক্রির জন্য ১৩৪ ও সিদ্ধ চাল বিক্রির জন্য ১৩ জন মিল মালিক খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ধান সংগ্রহ করবে এক হাজার ৭৪৭ মে. টন। মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল ও কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করবে সরকার।

সরকারের এই কর্মসূচিতে মিল মালিকেরা চাল বিক্রি করে বড় ধরনের লাভবান হলেও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। ফড়িয়া ও দালালরা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনছে মণপ্রতি ৫শ থেকে ৫৫০ টাকা দরে। কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৩ টাকা। অথচ ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২-২৪ টাকা। ধানে প্রতিকেজিতে অর্ধেক লোকসান গুণতে হচ্ছে কৃষকদের। কৃষকের ঘাম-রক্তে ফলানো ধানের দর নিয়ে প্রতারিত করছে দালালরা। তবে কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি ধান সরকার কিনছে ২৬ টাকা করে। কিন্তু খাদ্য বিভাগের হয়রানির ভয়ে কৃষকেরা খাদ্য গুদামে যেতে অনীহা রয়েছে বলে দাবি কৃষকদের।

ধানের ন্যায্যমূল্যে থেকে কৃষক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার চিত্র ফুটে ওঠেছে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীনের ফেসবুক স্ট্যাটাসে। এতে দেখা যায়, দালাল আর ফড়িয়া ব্যবসায়ী কৃষকদের ধানের দর দিচ্ছে কেজিপ্রতি ১০ টাকা করে। অথচ সরকার প্রতিকেজি ২৬ টাকা করে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করছে। উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে এই বিষয়ে যোগাযোগ করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন।

চালের বাজার দরের চেয়ে সরকারি ক্রয়মূল্য বেশি হওয়ায় প্রতিকেজিতে মিল মালিকদের লাভ থাকবে কেজি ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা। লাভ বেশি থাকায় মিল মালিকেরা সরকারকে চাল দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। বেশির লাভের জন্য শুধু মিল মালিকেরা নয়, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা তুষ্ট রয়েছে। খাদ্য বিভাগকে তুষ্ট করে চাল বিক্রি করতে হয়।

একাধিক মিল মালিক পূর্বকোণকে বলেন, চালে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা যাচাই করে চাল নেয় খাদ্য বিভাগ। সরকারের সেই ঘোষণায় খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদেরও তুষ্ট করতে হয়। তাদের তুষ্ট করতে পারলেই আদ্রতা ৮-১০ শতাংশ থাকলেও গ্রহণ করা হয়। সবই নির্ভর করছে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মর্জিমাফিক।
কিন্তু ২০১৭ সালে ছিল উল্টো চিত্র। সেবার বাজারে চালের মূল্য ছিল ৩৫-৩৬ টাকা। সরকারি মূল্য ছিল আতপ চাল ৩৩ টাকা ও সিদ্ধ চাল ৩৪ টাকা। লোকসানের কারণে মিল মালিকেরা সাড়া দেয়নি। ২০১৭ সালের চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছিল সরকার। চলতি বছর চালের দামের চেয়ে সরকারি দর বেশি থাকায় বেজায় খুশি চাল মিল মালিকেরা।

খাদ্য বিভাগ জানায়, চলতি বছর চান্দগাঁও থানা থেকে মিল মালিকদের কাছ থেকে সরকার চাল কিনবে এক হাজার ৫৫০ মে. টন, পাহাড়তলী এলাকা থেকে ৩৭২ মে. টন, পাঁচলাইশ থেকে ৭১ মে. টন এবং জেলার কর্ণফুলী থেকে একশ মে. টন, মিরসরাই থেকে ১২৭ মে. টন, বোয়ালখালী থেকে ৯২ মে. টন আতপ চাল সংগ্রহ করবে। অপরদিকে মিরসরাই থেকে ১৮২ মে. টন, সীতাকু- থেকে ৮২ মে. টন ও ফটিকছড়ি থেকে ৫৯৭ মে. টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করবে।

ধান সংগ্রহ করবে এক হাজার ৭৪৭ মে. টন। এতে দেখা যায়, আনোয়ারা উপজেলা থেকে ১৮৫ মে. টন, বাঁশখালীতে ২৮৯ মে. টন, বোয়ালখালীতে ৫৬ মে. টন, চন্দনাইশে ১০৩ মে. টন, ফটিকছড়িতে ২৩৪ মে. টন, হাটহাজারী ও লোহাগাড়ায় ১০৩ মে. টন করে, মিরসরাইয়ে ৪৩ মে. টন, পটিয়ায় ১৩২ মে. টন, রাঙ্গুনীয়ায় ২২০ মে. টন, রাউজানে ৯৭ মে. টন, সাতকানিয়া ১৯৪ মে টন ও নগরীর পাঁচলাইশে ২০ মে. টন ধান সংগ্রহ করবে সরকার।

উপজেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটির সভাপতি হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য সচিব হচ্ছে খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা। কৃষি বিভাগের ধান উৎপাদনের তথ্য অনুযায়ী ইউনিয়নভিত্তিক বরাদ্দ নির্ধারণ করবে উপজেলায় পর্যায়ের কমিটি। কিন্তু একাধিক সূত্র ও কৃষক জানায়, দালাল ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে ১২-১৩ টাকায় ধান কিনে সরকারকে ২৬ টাকা দরে বিক্রি করছে। কৃষক কার্ড যাচাই করে খাদ্য বিভাগ ধান কেনার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু দালালরা কৃষকের কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহ বা ভুয়া কার্ড বানিয়ে খাদ্য বিভাগের কাছে ধান বিক্রি করে। এজন্য খাদ্য বিভাগকে লাভের ভাগ গুণতে হয় দালালদের।

চট্টগ্রাম রাইস মিলস মালিক সমিতির সভাপতি শান্তু দাশগুপ্ত পূর্বকোণকে বলেন, মিল মালিকেরা লাভ হলেও কৃষক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফড়িয়া ও দালালদের খপ্পরে পড়ে ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, বোরো ধান তোলার পর কৃষক বিক্রি না করে মজুত করলে লাভবান হবে।

২০১৭ সালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি দরের চেয়ে বাজারে চালের দাম বাড়তি থাকায় সেই সময়ে অনেক মিল মালিক সরকারকে চাল দেয়নি। তারপরও লাইসেন্স টিকিয়ে রাখার জন্য ১০ জন মিল মালিক চাল বিক্রি করেছিল। সরকারের লক্ষ্যমাত্রার ১১ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল সেবার।

সরকারের চাল সংগ্রহের বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে সিদ্ধ চালের প্রচলন কম। আতপ চাল খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত অনেকটা ভুল। কারণ এসব চাল পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। এতে সরকারকে উল্টো পরিবহন খরচ গুণতে হয়। অপরদিকে অন্য জেলায় আতপ চালের প্রবণতা কম। সেখানে সিদ্ধ চাল বরাদ্দ কমে যায়। চট্টগ্রাম থেকে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ সরকার জন্য দুই ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মিল মালিকেরা সরকারের কাছে চাল বিক্রি করে লাভবান হলেও খাদ্য বিভাগ নির্দিষ্ট হারে কমিশন দিতে হয়। কেজিপ্রতি নির্ধারিত কমিশন না দিলে চাল সংগ্রহে টালবাহনা করা হয় বলে জানায় মিল মালিকেরা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট