চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

একাউন্ট জয়নালের, ব্যবহারে সবাই!

অবৈধ লেনদেন এক একাউন্টে লেনদেন করতেন ইসির চারকর্মীসহ আটজন

ইমাম হোসাইন রাজু

১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:২১ পূর্বাহ্ণ

মাত্র একটি ব্যাংক একাউন্ট। তাও এক ব্যক্তির নামে। কিন্তু এই একাউন্টেই ব্যবহার করতেন আটজনে। নিয়মানুযায়ী একজনের নামে থাকা ব্যাংক একাউন্ট অন্য কেউ ব্যবহার করার সুযোগ নেই। তবে তা করে দেখিয়েছেন ওরা আটজন। একাউন্টের এমন ব্যবহারের নজির কোথাও না থাকলেও চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের একটি সিন্ডিকেটেই তা সম্ভব করেছেন। যার নেতৃত্বে দিয়েছেন শুধুমাত্রই একজন পিয়ন। এই একাউন্টের মাধ্যমেই গত দুই বছরে আটজনে মিলে অবৈধ লেনদেন করেছেন প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। শুধু একটি ব্যাংকেই নয়। এমন আরও দুটি ব্যাংক ও একটি পরিবহনের মাধ্যমে আরও ৬৮ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন করেছেন। যার সবগুলো টাকাই ছিল অবৈধভাবে রোহিঙ্গা নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিনিময় মাত্র।
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চচল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার দুদকের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের চার কর্মচারীসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে দুদক। মামলার দুই আসামিকে গতকাল সকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এছাড়া চারজন আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের নাগরিক পত্র দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন দুইজন ।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে ডবলমুরিং থানার নির্বাচন অফিসের পিয়ন জয়নাল আবেদিন তার নামে নগরীর চকবাজার শাখায় ইসলামী ব্যাংকে একটি একাউন্ট খোলেন। যার হিসাব নং-২০৫০১৬২০২০৪৯৮৫৩০৭। গত দুই বছরে এই একাউন্টে বিভিন্ন স্থান থেকে জমা হয় সর্বমোট ৩৫ লাখ ৩ হাজার ১৫২ টাকা। আর তা থেকে উত্তোলন করা হয় ৩৪ লাখ ৯১ হাজার ৯৭৫ টাকা। এরমধ্যে জয়নালের স্ত্রী আনিছুন নাহার বেগম ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দেন এই একাউন্টেই। তবে তিনি উত্তোলন করেন ৯ লাখ টাকা। রোহিঙ্গাদের দালাল হিসেবে কাজ করা মো. জাফর ৬০ হাজার টাকা জমা দিলেও তিনি উত্তোলন করেন ৩ লাখ ৬৫ টাকা। নির্বাচন কমিশনের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সত্য সুন্দর দে এই একাউন্ট থেকে একসাথেই উত্তোলন করেন দেড় লাখ টাকা। এছাড়া জয়নাল আবেদীনের বান্ধবী সুমাইয়া জাহান প্রকাশ সীমা দাশ একই একাউন্টে জমা করেন ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। একই সাথে তিনি উত্তোলন করেন এক লাখ টাকা। সুমাইয়া বা সীমার ভাই বিজয় দাশও এই একাউন্ট থেকে ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা উত্তোলন করেন।

অন্যদিকে জয়নাল আবেদীনের নামে জেলার আনোয়ারা শাখার আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের আরেকটি একাউন্টেও এমন লেনদেনের তথ্য পায় দুদক। যার লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন স্থানে লেনদেন করেছেন ২৮ লাখ ২০ হাজার ১৪৪ টাকা। আর উত্তোলন করেছেন ২৮ লাখ ৫৫৬ টাকা। এতেও কক্সবাজারের জাফর ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়ে উত্তোলন করেন ৬ লাখ টাকা। এছাড়া সত্য সুন্দর দে’ও একই একাউন্ট থেকে ১ লাখ ৯৭ টাকা উত্তোলন করেন। এছাড়া একই ব্যক্তি এস এ পরিবহনের মাধ্যমে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকাও উত্তোলন করেন।
এদিকে জয়নাল আবেদীনের এই দুই একাউন্ট ছাড়াও জেলার বাঁশখালীতে থাকা প্রাইম ব্যাংকে তার নামে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার স্থিতি পায় দুদক। যা ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে।

দুদক জানায়, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিকরণে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ল্যাপটপ ও মডেম, আইরিশ সনাক্তকরণ মেশিন, সিগনেচার প্যাড ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন ব্যবহার করে নিজ বাসায় ছবি তুলে ডাটা তৈরি করে ঢাকায় সত্য সুন্দর দে’র কাছে পাঠাতেন পিয়ন জয়নাল আবেদীন। যার জন্য সত্য সুন্দর দে অর্থ সুবিধা নিতেন। এছাড়া ঋষিকেশ দাশ এ কাজে সহযোগিতা করতেন। নিরুপন কান্তি নাথ অবৈধ উপায়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিকরণ ও ভোটার তালিকায় অর্ন্তভূক্তিকরণের মাধ্যমের জন্যও অর্থ সুবিধা নিতেন। বাকিরা রোহিঙ্গা নাগরিকদের সংগ্রহ এবং এ কাজে সহযোগিতা করতেন। যার জন্য প্রত্যেকেই অর্থ সুবিধা পেতেন।

এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘জয়নাল একজন পিয়ন। কিন্তু তার তিনটি ব্যাংকের একাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন। যার বিষয়ে তথ্য উপাত্ত-সংগ্রহণ করে ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার এ কাজে অন্যরা সহযোগিতা করতে। যার জন্য তারও এই অর্থের ভাগ পেতেন। একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে মাত্র কয়েক দুই বছরের এমন লেনদেন অসৎ উদ্দেশ্যেমূলক ও ক্ষমতার অপব্যবহারের শামিল। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন,২০১২ এর ৪(২) ধারা এবং দন্ডবিধি’র ১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রাতরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট