চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

নিম্নমানের ভোজ্য তেল বিক্রির দায়ে ২৬ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল

অনলাইন ডেস্ক

৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ১০:৪৮ অপরাহ্ণ

বাজারে নিম্নমানের ভেজাল ভোজ্য তেলে ছেয়ে গেছে। নামিদামি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি অখ্যাত অনেক ব্র্যান্ডের ভোজ্য তেলও রয়েছে এর মধ্যে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স ছাড়াই ভোজ্য তেল বাজারজাত করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের মেয়াদ পার হয়ে গেলেও সেটি নবায়ন না করেই সঠিক মান বজায় না রেখে ভোজ্য তেল বাজারজাত করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এ রকম ২৬ প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই ২৬ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করেছে বিএসটিআই। বিএসটিআই সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সারা দেশে এখন ভিটামিন ‘এ’সমৃদ্ধ ফর্টিফাইড সয়াবিন ও পাম অলিন তেল বিক্রি করার কথা। কিন্তু ভোজ্য তেল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ নিয়ম সঠিকভাবে অনুসরণ না করে ভেজাল ভোজ্য তেল বিক্রি করছে। এই ভেজাল সয়াবিন ও পাম অলিন তেল মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এর অনেকগুলোতেইে এসিটিক এসিডের মাত্রা অনেক বেশি, যা মানবদেহ ক্ষয়কারী এসিড। এটি চোখে জ্বালা সৃষ্টি করে, নাকে শুষ্কতা ও প্রদাহ তৈরি করে এবং ফুসফুস ও লিভারের ব্যাপক ক্ষতি করে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়েটিক ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মোহছেন চৌধুরী জানান, ভেজাল ও মানহীন ভোজ্য তেলের নিয়মিত ব্যবহার জনসাধারণের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এটি স্বল্পমেয়াদে বদহজম, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, খাবারে অরুচি ও হৃৎপিণ্ডে ক্ষত সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদে হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ ও ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে। ভোজ্য তেলে এসিটিক এসিডের মাত্রা বেশি হলে টক্সিসিটি বেড়ে যায়। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার আগেই ভেজাল রোধে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি দোষীদের শাস্তির বিধান আরও কঠোর করতে হবে।

বিএসটিআই সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান ভেজাল ও নিম্নমানের ভোজ্য তেল বাজারজাত করায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই অভিযান পরিচালনা করা হয় বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পায় বিএসটিআই। বিএসটিআইয়ের বেশ কয়েকটি মোবাইল কোর্ট টিম ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে অভিযান চালায়। এতে দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠান মানহীন ভোজ্য তেল রিফাইন করে খোলা ও বোতলজাত আকারে বাজারজাত করে আসছিল। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স ছিল না। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে লাইসেন্স থাকলেও সেগুলো ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।

এসব কারণে অভিযুক্ত ২৬ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করেছে বিএসটিআই। এর মধ্যে অধিকাংশই ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল মোড়কজাত ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান। আর কিছু প্রতিষ্ঠান পাম অলিন তেল বাজারজাত করে আসছিল। লাইসেন্স বাতিল হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা রোডের জেবি ফুড সার্ভিসের কেয়া ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন ও পাম অলিন তেল। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কুতুবপুর এলাকার পদ্মা কনজুমার এন্ড বেভারেজের তিনটি ব্র্যান্ড সুপার পদ্মা, তীব্র, নদী ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর অলিপুর এলাকার এমএইচ এডিবল অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেডের আরাফাত ও পাবদা ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন এবং নীল ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল। চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার জেএস মার্কেটিং কোম্পানির মিনার ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল ও ফর্টিফাইড পাম অলিন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ তারাব এলাকার জীবন ফুড প্রোডাক্টসের  জীবন ও তাইফ ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। সিলেটের গোলাপগঞ্জের কোতোয়ালপুর এলাকার কর্ণফুলী ফুড প্রোডাক্টসের শাপলা ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল, ফর্টিফাইড পাম অলিন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ জালকুঁড়ি এলাকার মোস্তফা ফুড প্রোডাক্টসের আপেল, সুগন্ধা ও গোলাপফুল ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং অলিভিট ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। নারায়ণগঞ্জের বন্দর মদনপুর এলাকার টাইটানিক ফুডস লিমিটেডের টাইটানিক ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল ও ফর্টিফাইড পাম অলিন। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ এলাকার খাদিজা ফুড প্রোডাক্টসের সিটি ও সিটিজেন ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। নরসিংদীর রায়পুরা শ্রীরামপুর বাজার এলাকার লাইফ ফুড এন্ড কনজুমার কোম্পানির লাইফ ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল ও ফর্টিফাইড পাম অলিন। ঢাকার মিরপুর সেকশন-১২ এলাকার এমএস ফুড প্রোডাক্টসের টুডে ও ডলফিন ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং টুডে ন্যাচারাল ও ডলফিন ন্যাচারাল ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ এলাকার এমকেএস ফুড প্রোডাক্টসের বিকাশ ও অ্যাডিভয়েল ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল। সিলেটের গোটাটিকর এলাকার রনি অ্যাডিবল ফুড প্রোডাক্টসের ডায়মন্ড ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং রনি ও গোল্ডেন ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকার অমি ফুড প্রোডাক্টসের সানরাইজ ও পিউষ ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। গাজীপুরের শ্রীপুর মাওনা চৌরাস্তা এলাকার আরবি অয়েল এন্ড ফুড প্রোডাক্টসের রানী ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল ও ফর্টিফাইড পাম অলিন।

এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ বাতেনপাড়া এলাকার সেফটি এডিবল প্রোডাক্টস লিমিটেডের সেফটি ও শক্তি প্লাস ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। সিলেটের খাদিমনগর এলাকার আরবি এডিবল ফুড প্রোডাক্টসের তৃপ্তি ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং আরবি ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। ঢাকার কদমতলী এলাকার খান ফুড এন্ড এগ্রোবেস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মন, মাদার, পোগো ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। কুমিল্লার দাউদকান্দি রায়পুর এলাকার আবির কনজুমার ফুড প্রোডাক্টসের টিচার ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং স্টার ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কনফিডেন্স এডিবল অয়েল লিমিটেডের কনফিডেন্স ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। ফেনীর গোডাউন কোয়ার্টার এলাকার দাউদিয়া অয়েল মিলের চান মার্কা, ডাবল চান মার্কা ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া দক্ষিণ বাজার এলাকার এইচএবি অয়েল এন্ড ফুড প্রোডাক্টসের জোনাকি ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফাইভ স্টার সুপার ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। মুন্সীগঞ্জের সদর ঘাসিপুকুরপাড় এলাকার সততা ফুড প্রোডাক্টসের মিনিস্টার ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং মাযোলা ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। নরসিংদীর শিবপুর শীষপুর এলাকার মদিনা অয়েল মিলের মদিনা ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। ঢাকার চকবাজারের সাইফ এডিবল ফুড প্যাকেজিংয়ের মক্কা ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং সাবরিনা ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড পাম অলিন। সিলেটের কদমতলী গোটাটিকর এলাকার মঞ্জিল ফুডসের মঞ্জিল ব্র্যান্ডের ফর্টিফাইড সয়াবিন তেল এবং ফর্টিফাইড পাম অলিন। তথ্যসূত্র: সময়ের আলো

 বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক (সিএম) মো. রেজাউল হক জানান, এসব প্রতিষ্ঠান ভেজাল ও নিম্নমানের সয়াবিন এবং ভোজ্য তেল বাজারজাত করে আসছিল। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের মেয়াদ পার হয়ে গিয়েছিল। লাইসেন্স ও লাইসেন্সিং এগ্রিমেন্টের শর্তানুযায়ী মেয়াদ উত্তীর্ণের পর থেকে লাইসেন্সের কোনো বৈধতা নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন আইন ২০১৮-এর ১৬(৫) ধারা এবং লাইসেন্সিং এগ্রিমেন্ট মোতাবেক এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সগুলো বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলো বিক্রি-বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশের ভোক্তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো পণ্য ক্রয় থেকে যেন তারা বিরত থাকেন।

সয়াবিনের পুষ্টিগুণ : বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (এফএও) গ্লোবাল ফোরাম ফর নিউট্রিশনের তথ্যানুযায়ী, মানবদেহে দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৩০ শতাংশ ভোজ্য তেল থেকে আসা উচিত। অথচ দেশে মাথাপিছু বার্ষিক ভোজ্য তেল ব্যবহারের হিসাবে দৈনিক প্রাপ্ত ক্যালরির মাত্র ৯ শতাংশের উৎস ভোজ্য তেল। মানবদেহের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান ফ্যাটি এসিডের প্রধান উৎস ভোজ্য তেল। কিন্তু অতিমাত্রায় ভেজালের কারণে কাঙ্খিত মাত্রায় মিলছে না এসব প্রয়োজনীয় উপাদান। উল্টো বাড়িয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

গো-খাদ্য থেকে মানব খাদ্য সয়াবিন : সয়াবিন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রে গরুর খাদ্য হিসেবে সয়াবিন ব্যবহার হতো। পরে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয় সয়াবিনের ওপর ব্যাপক গবেষণা শুরু করে। ১৯০৪ সালে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ডা. জি ডাব্লিউ কারভার আবিষ্কার করেন, সয়াবিনে এমন সব অসাধারণ উপাদান বিদ্যমান, যা মানবদেহের স্বাস্থ্য রক্ষায় অতীব জরুরি। তিনি প্রমাণ করেন, সয়াবিন তেল সব খাবারের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এটি উৎকৃষ্টমানের উদ্ভিজ্জ খাদ্য এবং স্বাস্থ্যকর উদ্ভিজ্জ তেলের আধার। তাই মানবদেহের পুষ্টিবিধানে সয়াবিন তেলকে বলা হয় পুঞ্জীভূত শক্তির আধার। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে সেই পুঞ্জীভূত শক্তির আধার ভেজালের কারণে বাংলাদেশে আজ অপশক্তিতে পরিণত হয়েছে।

 

পূর্বকোণ-রাশেদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট