চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

দায় নেই বিএসটিআই’র

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন হ

১০ মে, ২০১৯ | ২:৪০ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র মাহে রমজানকে ঘিরে ভেজালে ভেজালে সয়লাব বাজার। ভেজালের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ক্রেতারা। বিশেষ করে ঘি, সেমাই, তেল, পানিতে ভেজালের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত। ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ঘি জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) যেন কোন দায় নেই।
বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘বিএসটিআই আইন-২০১৮ এ মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা আমাদের দেইনি। আমরা এখন র‌্যাব, জেলা প্রশাসন বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে করছি। ভেজাল বা নকল পণ্য নির্ণয় করে দিচ্ছি।’
বিএসটিআই সূত্র জানায়, গতকাল নগরীর বিভিন্ন বাজার ছাড়াও জেলার হাটহাজারী, আনোয়ারাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ঘি’র নমুনা সংগ্রহ করেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসব ঘি’র কোম্পানির ছাড়পত্র বাতিল করা হবে।
কিন্তু ঘি’র নমুনা পরীক্ষা করতে প্রায় ২২ দিন সময় লাগবে বলে জানান সহকারী পরিচালক হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘নমুনা সংগ্রহ করা একটি কোম্পানির ঘি প্রাথমিক পরীক্ষায় ভেজাল পাওয়া গেছে। ওই কোম্পানিকে নোটিস দেওয়া হয়েছে। নোটিসের জবাব সন্তোষজনক না হলে কোম্পানির ছাড়পত্র বাতিল করা হবে।
রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে হাটহাজারীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ঘি জব্দ করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন। গতকালও বুড়িশ্চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি ঘি তৈরির কারখানা থেকে দেড় হাজার লিটার ভেজাল ঘি জব্দ করেছেন। এর আগে হাটহাজারী পৌরসভার আল করিম কাঁচা বাজার এবং কাচারি রোড এলাকার কয়েকটি মুদি দোকানে অভিযান চালিয়ে এক হাজার লিটার ভেজাল বাঘা বাড়ির ঘি জব্দ করেছেন তিনি।
হাটহাজারী ছাড়াও নগরীর বায়েজিদ শিল্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ঘি জব্দ করেছেন চসিক। বিক্রয়ের জন্য মজুদ করা পাম্প অয়েল সদৃশ্য ২ শ কার্টুন ঘি ধ্বংস ও ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন চসিক ভ্রাম্যমাণ আদালত।
নগরীর কোতোয়ালী এলাকার জামালখানের একটি বাসায় বসে ডালডার সঙ্গে সুগন্ধি ও রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে ঘি তৈরি করে ‘পাবনার বাঘাবাড়ির ঘি’ নামে বাজারজাত করার প্রস্তুতির সময় বিপুল পরিমাণ ভেজাল ঘি জব্দ করেছে কোতোয়ালী পুলিশ।
জানা যায়, নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা ভেজাল ঘি নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাত করা হচ্ছে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন বলেন, প্রতি বছর রোজার মাসকে ঘিরে ভেজাল ও নকল ঘি তৈরির প্রবণতা চলে আসছে। তাই কয়েক মাস আগ থেকে অভিযান শুরু করা হয়। অভিযানের কারণে অসাধু কারবারিরা স্থান পরিবর্তন করে গোপন স্থানে ভেজাল ঘি তৈরি করে আসছে। বেশি লাভের আশায় নানা ধরনের ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল ঘি। বাঘা বাড়িসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘি ভেজাল করে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ কারণে রোজার মাস শুরু হওয়ার আগ থেকে বিভিন্ন দোকানে অভিযান চালানো হচ্ছে।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে ঘি তৈরির কারখানা গড়ে ওঠেছে। বিশেষ করে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, রাজাখালী, হালিশহর, বায়েজিদ, কালুরঘাট শিল্প এলাকায় এই ধরনের কারখানা গড়ে ওঠেছে। বছরজুড়ে চাহিদা কম থাকলে রোজার মাসকে ঘিরে চাহিদা বেড়ে যায়। এই সুযোগে কিছু অসাধু ঘি কারবারি ভেজাল ও নকল ঘি তৈরি করে আসছে। ইতোধ্যে এসব ঘি নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পৌঁছে গেছে। নামসর্বস্ব কোম্পানি ছাড়াও নামকরা বিভিন্ন ব্যান্ডের লেভেল লাগিয়েও ভেজাল ঘি বাজারজাত করা হচ্ছে।
বিএসটিআই সূত্র জানায়, অনুমোদন বা ছাড়পত্র নেওয়ার সময় উন্নত-ভালো মানের ঘি জমা দেয়। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু ছাড়পত্র দেওয়ার পর বিএসটিআইয়ের যেন আর কোন দায় নেই। তবে বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, বিচারিক ক্ষমতা না থাকায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাথে সমন্বয় করে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা প্রশাসনের এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ভেজাল পণ্য নিয়ে বিএসটিআইয়ের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। সরকারি সংস্থাটি কঠোর হলে ভেজালের পরিমাণ অনেকাংশে কমে আসবে।
একাধিক সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ছাড়পত্র নিয়ে বাণিজ্য চলে আসছে বিএসটিআইয়ে। টাকা দিলেই ছাড়পত্র মিলে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে খুচরা বাজারে ভেজাল-নকল পণ্যে সয়লাভ হয়ে গেছে। সেমাই, ঘি ও নুডলস ছাড়াও বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি নামকরা চেইনশপগুলোও ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসন বাজার মনিটরিং করার জন্য ৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সাতটি টিম গঠন করেছে। এসব টিম প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। রজমান মাসজুড়ে বাজার মনিটরিং, অতিরিক্ত মুনাফা ও ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করবে এসব টিম। জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম বাজার মনিটরিং ও ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আসলেও পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র সরকারি সংস্থা বিএসটিআইয়ের কার্যক্রম এখনো চোখে পড়েনি। এতে ভেজাল ও নকল পণ্যের ব্যবহার রোধ করা যাচ্ছে না। ভেজাল ঘি, সেমাই, খেজুর নির্বিঘেœ বাজারে চলে আসছে ভেজাল পণ্য। ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনায় বিএসটিআইয়ের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অথচ এ সংস্থাটির আগের চেয়ে ক্ষমতা ও জনবল বেড়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)।
ক্যাব দাবি করেছে, ভেজালে বাজার সয়লাভ হয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি দায় এড়াতে পারে না। ভেজাল ছাড়াও প্যাকেট ও বোতলজাত পণ্যে ওজনে কম দিয়ে ক্রেতাদের ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। সেমাই, ঘিয়ে ক্ষতিকারক রং মিশানো হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের ঠকানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বিএসটিআই মূল দায়িত্ব থেকে সরে গেছে।
জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএসটিআই এ পর্যন্ত ভেজাল ও নকল পণ্যের বিষয়ে কোনো ধরনের তথ্য দেয়নি। ভেজালবিরোধী অভিযান চালানোর বিষয়ে সংস্থাটির কোনো মাথাব্যথা নেই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট