চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগে আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষোভ ও বিস্ময়

বিবিসি

৭ আগস্ট, ২০২৪ | ৩:৩৭ অপরাহ্ণ

পনের বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসনের পর ছাত্র আন্দোলনের মুখে অনেকটা হুট করেই দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে চলে যাওয়ার ঘটনায় তার দল আওয়ামী লীগের মধ্যে কার্যত চরম বিপর্যয় ও হতাশা নেমে এসেছে।

 

দলটির ‘হতভম্ব’ নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যেই তৈরি হয়েছে ক্ষোভ এবং বিস্ময়, কারণ এমন কিছু হতে পারে তার কোন ধারণা একদিন আগেও তারা পাননি। গত দু’দিনে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী কয়েকজনের সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

 

এমন পরিস্থিতিতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাই কার্যত এখন ‘আত্মগোপনে’ এবং কবে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিংবা আদৌ পারবেন কিনা তা নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেকে। এর ফলে দলকে টিকিয়ে রাখা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে দলের অনেকের মধ্যে। যদিও শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জে ‘তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার’ প্রতিবাদে মঙ্গলবার দু’দফা মিছিল ও সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগের একদল নেতাকর্মী।

 

দলটির মধ্যম পর্যায়ের একজন নেতা বলেছেন, নতুন সরকারে কারা আসে সেটা দেখে এবং যদি সম্ভাব্য ধরপাকড় এড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবার পর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন তারা।

 

এখানে বলে রাখা ভালো, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশকিছু নেতার সাথে সোম ও মঙ্গলবার বিবিসির কথা হয়েছে। তবে তারা সবাই তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

 

ওদিকে, শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তার সন্তান সজিব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছেন যে, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না এবং তিনি হতাশ। এর মাধ্যমে দেশের রাজনীতির মতো ‘আওয়ামী লীগেও আপাতত শেখ হাসিনা অধ্যায় শেষ হলো’ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন।

 

তিনি বলেন, তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। কিছুদিন আগেও যেমন আজকের পরিস্থিতি অবাস্তব ছিল। তবে এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ও তার ছেলে জয়ের কথা আমলে নিলে আপাতত তার রাজনীতিতে ফেরা কঠিন।

 

প্রসঙ্গত, সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা সামরিক হেলিকপ্টারে প্রথমে ত্রিপুরার আগরতলা ও পরে সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দিল্লি পৌঁছান।

 

এরপরপরই ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে আন্দোলনকারীরা এবং ওইদিন বিকেলেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন ও জাদুঘর। হামলা হয় শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনেও। এরপর দলটির বহু সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে সারাদেশে।

 

যদিও বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরীসহ প্রবীণ নেতারা ঢাকাতেই তাদের বিবেচনায় নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন।

 

সিনিয়র নেতারা কিছু জানতেন কি

 

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাতকারে সজিব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, তার মা একদিন আগে অর্থাৎ রবিবার থেকেই পদত্যাগের চিন্তা করছিলেন।

 

যদিও দলের সিনিয়র নেতাদের সবাই এ বার্তা পাননি বা তাদেরকে এ বিষয়ে কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। কিংবা সিনিয়র নেতাদের একটি বড় অংশ বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরে পড়তে পেরেছেন।

 

রবিবারই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দু’জন সদস্য আব্দুর রহমান ও ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ছাত্র আন্দোলনকে তারা রাজপথেই মোকাবেলা করবেন। অর্থাৎ, আন্দোলন দমন করে ক্ষমতায় থাকার বিষয়ে তখনও তারা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী।

 

সেদিনও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সাথে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে এবং এসব সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

 

সোমবার শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকে ওই দুই নেতাই আত্মগোপনে রয়েছেন এবং পরে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাদের একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন মঙ্গলবার বলেছেন, ওনারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে এমন কিছু হয়ে যাবে।

 

তবে ধারণা করা হয়, শেখ হাসিনার সরকার ও দলের কিছু লোকজন অবস্থা অনুধাবন করে শনি ও রবিবার ঢাকা ছেড়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন।

 

‘এ অবস্থা কিন্তু নতুন নয়’

 

আওয়ামী লীগের খুলনা অঞ্চলের একটি জেলার প্রবীণ একজন নেতা অবশ্য বলেছেন, তিনি মনে করেন তার দল এমন অবস্থায় এবারেই প্রথম পড়েনি।

 

তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে আমি ডিগ্রির ছাত্র ও দলের কর্মী । হুট করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেলাম। তখন আমরা এমন পরিস্থিতিতেই পড়েছিলাম। বহু বছর পালিয়ে ছিলাম। ঘুরে দাঁড়াতে সময় লেগেছিল। এখন শেখ হাসিনার পর কে হাল ধরবেন আমি জানি না। তবে সময় হলে কেউ না কেউ আসবেই।

 

প্রসঙ্গত, পচাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৮১ সালের মে মাসে দেশে ফিরে এসে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। তার আগে অবশ্য ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলটির রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন শুরু হয়েছিল।

 

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন এমন একজন বলছেন যে, এবারের নতুন পরিস্থিতি মেনে নেয়া ও এতে ধাতস্থ হতে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনেক সময় লাগবে। অনেকেই হয়তো রাজনীতিই ছেড়ে দিবেন। পরে কী হবে আমি জানি না।

 

এবারের সহিংসতায় ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে পরে মারা গেছেন। ওই এলাকাতেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এমন একজন বলছিলেন যে, তিনি মনে করেন শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ায় আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর আপাতত কোন সুযোগ নেই।

 

‘দেশত্যাগ মেনে নেয়া কঠিন’

 

আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেতা বলেছেন, তিনি মনে করেন ক্ষমতা হারানোর চেয়ে বড় আঘাত হলো দলীয় সভানেত্রীর দেশ ছাড়া।

 

তিনি বলেন, আমি জানি না এটা কেন তিনি করলেন। যদিও বোঝাই যাচ্ছে পরিবারের চাপেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এর মূল্য অনেক হবে আমাদের জন্য।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা তার ফেসবুকে লিখেছেন, এর থেকে মৃত্যু হয়তো শ্রেয় ছিল…!! বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে… আপনাকেও নাহয় মেরে ফেলতো… আমি গৌরবের মৃত্যু নিয়েই যেতে চাই…. আমি গৌরবের পরাজয় চাই….!!

 

অর্থাৎ, শেখ হাসিনার এভাবে চলে যাওয়াটাও দলের অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। তারা মনে করছেন এটি তাদের জন্য অসম্মানজনক, যা রাজনৈতিকভাবেও তাদের জন্য বড় একটি আঘাত।

 

আবার কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলছেন যে, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন দলের আদর্শ নিয়েই থাকবেন তারা।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা হেমায়েত উদ্দিন অবশ্য লিখেছেন, আমি মুজিব আদর্শের সৈনিক, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই আদর্শ বুকে ধারণ করেই চলবো….।

 

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট