চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আতঙ্কে জুয়াড়িদের মনোরঞ্জন করা ‘ক্যাসিনো গার্লরা’

অনলাইন ডেস্ক

২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ৭:৩৭ অপরাহ্ণ

ক্যাসিনো বলতে বিশ্বব্যাপী যে স্থানটির নাম সবার আগে মাথায় ঘুরপাক খায় সেটি হল লাস ভেগাস। যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটির পরিচিতি ‘পাপের নগরী’ হিসেবে। যেখানে প্রতিমূহুর্তে উড়ে কয়েকশ মিলিয়ন ডলার। কথায় আছে ঢাকায় টাকা উড়ে। প্রচলিত এ বাক্যটিকে সত্যি করতে ঢাকায়ও গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ‘ক্যাসিনো’। যেখানে প্রতিরাতে উড়ে কয়েকশ কোটি টাকা। তাইতো টাকা উড়া দেখতে এখন আর ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোতে যেতে হবে না। সম্প্রীতি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) রাজধানীর এমন কিছু স্পটে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে প্রায় কোটি টাকা। আর এই অভিযানে আটকও হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা। এই অভিযান চলার পর থেকেই ধনীদের টাকা উড়ানোর জায়গা এই ‘ক্যাসিনো’ নিয়ে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানা গেছে, বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের এসব ক্যাসিনোতে আনা হতো। এমনকি প্রশিক্ষিত জুয়াড়ির পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রহরীও আনা হতো বিদেশ থেকে। ক্যাসিনোগুলোতে প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা উড়তো। এর পরিমাণ কমবেশি ১২০ কোটি টাকাও হতে পারে। এছাড়া ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে চীন ও নেপালের অন্তত ৪০০ প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণী ঢাকার বিভিন্ন ক্যাসিনোয় কাজ করতেন। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় তারা পারদর্শী। এমনকি তাদের চেহারাতেও রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ।

জানা গেছে, কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করতেন তারা । কেউ রিসেপশনে, কেউ ইলেকট্রোনিক জুয়ার বোর্ড অপারেটিংয়ে এবং কেউ নিয়োজিত ছিলেন ক্যাসিনো থেকে অর্থ পাচার কাজে। শুধু তাই নয় ক্যাসিনোয় আসা জুয়াড়িদের মনোরঞ্জনের জন্য আনা সুন্দরী গার্লদের রাখা হতো রাজধানীর গুলশান, নিকেতন, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, পল্টন, ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর এর বিভিন্ন এলাকার প্রাসাদোপম ভবনে। তাদের আনা-নেয়া করা হতো প্রতিষ্ঠানের কালো কাচঘেরা নিজস্ব গাড়িতে। নিরাপত্তা থেকে শুরু করে এসব গার্লদের থাকা-খাওয়া, সাজসজ্জা সব কিছুই বহন করত সংশ্লিষ্ট ক্যাসিনো পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানে ভিনদেশি এসব ক্যাসিনো গার্লরা পড়েছেন বিপাকে।

প্রশাসনের কড়া নজরদারির কারণে অধিকাংশই এখন যেতে পারছেন না নিজ দেশে। আবার অনেকের ভিসার মেয়াদ না থাকায় থাকতেও পারছেন না বাংলাদেশে। এদিকে যাদের ভরসায় এসেছিলেন, তারাও প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পালিয়েছেন। ফলে অজানা আতঙ্ক ভর করেছে তাদের মধ্যে। ঢাকার ক্যাসিনোয় শুধু ভিনদেশি তরণ-তরুণীই নয়, পেটের দায়ে অথবা বিলাসী জীবন-যাপনের জন্য এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাও। জুয়ার বোর্ড অপারেটিং ও অর্থ পাচারে ভিনদেশিদের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারাও এখন অভিজ্ঞ।

গতকাল শুক্রবার ক্যাসিনোয় কাজ করা কয়েকজন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তেও ক্যাসিনোর কর্মচারীদের বিষয়ে উঠে এসেছে এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ।

গত বুধবার বিকালে ফকিরেরপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোয় অভিযানকালে কর্মরত কয়েকজন চীনা ও নেপালি নাগরিককে আটক করে র‌্যাব। তাদের কারোরই ওয়ার্ক পারমিট নেই। আটকদের মধ্যে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা দুই তরুণীও ছিলেন। কাপড় পাল্টে থ্রিপিস পরতে চাইলে র‌্যাবের বাগড়ায় তারা বলেন, ‘পেটের তাগিদে জুয়ার বোর্ডে চাকরি করি, স্যার। আমাদের থ্রিপিসটা পরতে দেন। ওয়েস্টার্ন ড্রেস না পরলে চাকরি থাকবে না।’

নিজেদের নিরপরাধ দাবি করে নেপালের এক গার্ল জানান, ইয়ংমেন্স ক্লাবে দেড় মাস ধরে চাকরি করছিলেন। দৈনিক দুই শিফটে ১২ ঘণ্টা অন্তর মোট ১২ জন গার্ল কাজ করেন। ক্যাসিনোয় তাদের ‘ডিলার’ নামে সম্বোধন করা হয়। মাসিক ও দিন হিসেবে কখনো রিসেপশনে, কখনো বোর্ডে কার্ড সরবরাহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। রিসেপশনিস্টের বেতন ২১ হাজার আর কার্ড বিতরণকারীকে বেতন দেওয়া হতো ১০ হাজার টাকা।

তাদের স্বামী এ কাজের বিষয়ে জানলেও স্বজনরা জানত না। তিনি আরও জানান, ক্যাসিনোয় সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা এবং রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত জুয়া খেলা হয়। জুয়ার বোর্ডগুলো চালু করে চীনা নাগরিকরা। বোর্ড পরিচালনা করে নেপালিরা। দিনের প্রতি শিফটে ৭০-৮০ জন মানুষ খেললেও রাতের বেলায় বেশি মানুষের সমাগম হয়। ক্যাসিনোয় অনেকে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক সেবন করে বলেও জানান তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মতিঝিলের এক নেপালি গার্ল জানান, তাদের ক্যাসিনোয় পোকার (জুজু খেলা), কার্ডস মেশিনের খেলা ছাড়াও বাক্কারাট (বাজি ধরে তাস খেলা), রুলেট, পন্টুন, ফ্লাশ, বিট, ডিলার, কার্ডস,ব্লাকজ্যাক নামের জুয়া খেলা হতো। এ ছাড়া রেমি, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, ফ্লাশ-জুয়াও চলত।

আয়োজকরা ইয়াবা-মদের আসরের ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিত্তশালী পরিবারের তরুণরাও এখানে আসতো। বড় জুয়াড়িদের প্রথমে সম্ভাষণ করা হয় মদের গ্লাস দিয়ে। ফ্রিতে ছিলো বাহারি খাবারের আয়োজন।

তিনি আরও জানান, জুয়া পরিচালনার জন্য নেপালসহ পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েক দেশের তরুণীরা কাজ করেন। ভিজিট ভিসায় আসা তরুণীদের বেশিরভাগই নেপালি। লাখ টাকার বেশি অগ্রিম দিয়ে তাদের বিদেশ থেকে আনা হয়। বেতন ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

ঢাকার বিভিন্ন ক্যাসিনোয় কাজ করেন কমপক্ষে ২০০ ক্যাসিনো গার্ল। তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জন জুয়ার বোর্ড অপারেটিংয়ে পারদর্শী। অন্যদের কেউ কাজ করেন রিসেপশনে। প্রতিদিনই অন্তত ৫ জন ক্যাসিনো গার্ল ও ৫ জন ক্যাসিনো বয় ব্যাগে ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার নিয়ে নেপালে যান। সেখান থেকে সব টাকা একত্রিত করে হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়।

মতিঝিলের আরেকজন ক্যাসিনো গার্ল জানান, তাদের ক্যাসিনোর বিশাল হলরুমে প্রায় ২০টি বোর্ড ছিল। বোর্ডের চারপাশ ঘিরে দিন-রাত মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন জুয়াড়িরা। তাদের পাশ ঘেঁষে ভিনদেশি সুন্দরী তরুণীরা প্রতিনিয়ত খেলায় উৎসাহ দিতেন। কেউ এগিয়ে দেন মদের বোতল।  এ ছাড়া গ্রাহকদের আগ্রহী করতে ক্যাসিনোর পক্ষ থেকে নানা অফার দেওয়া হয়ে থাকে। ক্যাসিনো গার্লদের অনেক সময় জুয়াড়িদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও গড়তে হয়।

পূর্বকোণ/আল-আমিন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট