চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

জালিয়াতিতে তিন সিন্ডিকেট

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:২৫ পূর্বাহ্ণ

২০১৬ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের জালিয়াতির মাধ্যমে ভোটার করা হচ্ছে। এই জালিয়াতির সূত্র ধরে চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসে তিনটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। তিন সিন্ডিকেটের বাইরে রয়েছে উপ-সিন্ডিকেট। তারাও কাজ দেয় তিন সিন্ডিকেটকে। এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে ঢাকার কেন্দ্রীয় সার্ভারকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের নিবিড় সম্পর্ক। যার মাধ্যমে সহজেই ভুয়া এনআইডি পৌঁছে যেত রোহিঙ্গাদের হাতে। কাজের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সিন্ডিকেটের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া যায়। গ্রেপ্তার হওয়া পিয়ন জয়নাল আবেদীনও ভুয়া এনআইডি তৈরির বিষয়ে পুলিশকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।

ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের পিয়ন জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। জয়নাল বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। তার কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজে ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। জয়নালের একাধিক আত্মীয়স্বজন এখনো নির্বাচন অফিসের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত রয়েছেন। জয়নাল ছাড়াও ফেনীর মোস্তফা ফারুক নামে এক টেকনিকেল সাপোর্টের রয়েছে আলাদা সিন্ডিকেট। টেকনিকেল কাজে পারদর্শী মোস্তফা চট্টগ্রামের প্রতিটি উপজেলা ও নগরীতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং স্মাটকার্ড বিতরণ কাজে দায়িত্ব পালন করছেন। সুচতুর মোস্তফার কাছে ভোটার নিবন্ধনের সারঞ্জামাদি রক্ষিত থাকার সুবাদে কেন্দ্রীয় সুরক্ষিত সার্ভারে যেকোন কিছু আপলোড করা তার জন্য খুবই সহজ। দালাল চক্রের মাধ্যমে গড়ে তোলা রোহিঙ্গাসহ ভুয়া ভোটার করার একটি আলাদা সিন্ডিকেট। আরেকটি সিন্ডিকেট হচ্ছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের শাহনূরের সিন্ডিকেট। শাহনূরের গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলায়। তার এক ভাই কাজ করেন ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ে। দুই সহোদরের নেতৃত্বে রয়েছে আলাদা সিন্ডিকেট। শাহনূর বর্তমানে চিকিৎসার জন্য ভারতে রয়েছে বলে নির্বাচন কার্যালয় সূত্র জানায়। তিন সিন্ডিকেটের বাইরেও বিচ্ছিন্নভাবে কর্মচারীরা ভুয়া ভোটার কাজে জড়িত রয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের একাধিক সূত্র জানায়। এমনকি গাড়িচালকও ভুয়া এনআইডি’র কাজ করে থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রকল্পের অধীনে টেকনিকেল সাপোর্ট হিসেবে যোগদান করে মোস্তফা ফারুক। তার বাড়ি ফেনী জেলায়। ভোটার সংক্রান্ত যাবতীয় আপলোড করার কাজ হচ্ছে এই টেকনিকেল সাপোর্টের। বিভিন্ন উপজেলা ও থানায় টেকনিকেল সাপোর্ট হিসেবে কাজ করার সুবাধে লাইসেন্সধারী (নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ডধারী) ল্যাপটপ ব্যবহার ও আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) নাম্বার জানা থাকা মোস্তফার। নির্বাচন কমিশনের সেই নির্ধারিত ল্যাপটপ ও মডেম ছাড়া সুরক্ষিত কেন্দ্রীয় সার্ভারে ভোটার নিবন্ধন আললোড করা সম্ভব নয়। এছাড়াও ল্যাপটপসহ ভোটার নিবন্ধনের অন্যান্য সামগ্রী তার কাছে রক্ষিত থাকত। সেই সুবাদে মোস্তফা ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা ও ভুয়া ভোটার কাজে জড়িয়ে পড়েন। অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে দুইবার চাকরিচ্যুত হওয়ার পর কৌশলে চাকরিতে ফিরে আসেন তিনি। এই নিয়ে নির্বাচন কমিশনে রয়েছে কানাঘুষা।

২০১৪ সালে মিরসরাই উপজেলায় হালনাগাদ কর্মসূচিতে টেকনিকেল সাপোর্ট হিসেবে কাজ করেন মোস্তফা ফারুক। ২০১৫ সালে মিরসরাই উপজেলায় হালনাগাদ কাজে ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ তার কাছ থেকে গায়েব হয়ে যায়। এখনো যার হদিস পায়নি নির্বাচন কমিশন। ইসির লাইসেন্সধারী এই ল্যাপটপ থেকে ভোটার সংক্রান্ত যাবতীয় আপলোড করা সম্ভব।
এছাড়াও নগরীর কোতোয়ালী থানায় ভোটার তালিকা হালনাগাদে জালিয়াতির ঘটনায় চাকরিচ্যুত হন তিনি। ভুয়া জন্মসনদের মাধ্যমে আলহাজ মো. হাবিব উল্লাহ সওদাগর নামে এক ব্যক্তিকে ভোটার করতে গিয়ে তার জালিয়াতি ধরা পড়ে। কোতোয়ালী থানা তৎকালীন নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল লতিফ শেখের এক রিপোর্টে দেখা যায়, আলহাজ হাবিব উল্লাহ সওদাগরের জন্মসনদ ভুয়া হওয়ায় ফরম কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড না করার জন্য মোস্তফা ফারুককে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনা অমান্য করে অন্য আরেকটি ভোটার ফরম নং কেটে হাবিব উল্লাহ ফরম এক্সপোর্ট করা হয়। এছাড়াও মাহবুবুর রহমান রিপন নামে আরেক ব্যক্তির সংশোধন আবেদন নির্বাচন কর্মকর্তার অগোচরে ইসি’র কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড করেন মোস্তফা। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের উপ-পরিচালক মো. ইলিয়াস ভূঁইয়া তাকে প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশনা দেন। তারপরও ২০১৮ সালে স্মাটকার্ড বিতরণকালে ডবলমুরিং থানা অফিসে টেকনিকেল সাপোর্ট হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। সেখানেও অনিয়মের অভিযোগে চারকিচ্যুত করা হয়। দুই দফায় চাকরিচ্যুত হওয়ার পরও রহস্যজনক কারণে নির্বাচন কমিশনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় চাকরিতে ফিরেন মোস্তফা ফারুক। সেই টেকনিকেল সাপোর্ট মোস্তফা ফারুক এখন মো. মোস্তফা নামে হালনাগাদ কাজে কর্মরত রয়েছেন। সম্প্রতি বোয়ালখালী ও সন্দ্বীপ উপজেলায় হালনাগাদ কাজে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জয়নাল গ্রেপ্তার হলেও মোস্তফাকে ঘিরে রহস্যের জট ডালপাল মেলছে। কারণ হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিকেল সাপোর্ট হিসেবে কাজ করার সুবাধে ইসি’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে তার যোগসূত্র রয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সূত্র জানায়, জয়নাল ও মোস্তফা দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া ভোটার করার কাজে জড়িত রয়েছে। গত বছর মোস্তফাকে ডিঙিয়ে জয়নাল বেশি কাজ হাতিয়ে নেয়। এই নিয়ে দুই সিন্ডিকেটের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মূলত কেন্দ্রীয় সিন্ডিকেটের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কারণে জয়নাল একচেটিয়া কাজ করে চলেছে। এই বাইরে নীরবে কাজ চালিয়ে যায় শাহনূরের নেতৃত্বে তৃতীয় সিন্ডিকেট। পুলিশ ও দুদকের তদন্তেও তা ওঠে এসেছে বলে সূত্র জানায়। তিন সিন্ডিকেট ছাড়াও নির্বাচন কার্যালয়ে প্রবেশধারে একটি ফটোস্ট্যাস্টের দোকানেও ভোটার সংক্রান্ত বিভিন্ন ফরম পাওয়া যায়। কোন ব্যক্তি সেবার জন্য নির্বাচন অফিসে গেলে ওই দোকান থেকে ফরম সংগ্রহের পরামর্শ দিতেন।

গত ১৮ আগস্ট লাকী নামে এক রোহিঙ্গা নারী জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য হাটহাজারী নির্বাচন অফিসে যান। আইডি কার্ড নিয়ে সন্দেহ হলে পরদিন জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আনা হয়। ইসির কেন্দ্রীয় সার্ভারে লাকীর যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ থাকলেও উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যে লাকী নামে কোন এনআইডি ইস্যু করা হয়নি। এভাবে ভুয়া এনআইডি তৈরির জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পায়। এই ঘটনার পর তোলপাড় শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদক ও নির্বাচন কমিশনের একাধিক দল রোহিঙ্গা ভোটার নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট