হ তদন্ত শেষে মামলা করবে দুদকও হ ফেঁসে যেতে পারেন জনপ্রতিনিধিও হ দুটি ল্যাপটপ দিয়েই হয়েছে রোহিঙ্গা ভোটার
ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তির ঘটনায় জড়িত মূল হোতারা নিজেদের আড়ালে রাখতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশনের হয়ে মামলা দায়ের করেন। কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি গোপন করতেই পিয়ন জয়নালকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয় বলে ধারণা দুদকের। তাছাড়া দুদককে পাশ কাটিয়ে থানায় মামলা দায়ের করার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, মূল হোতাদের বাঁচাতেই এমন কাজটি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে থানায় মামলা হলেও এ বিষয়ে অনুসন্ধানের পর মূল হোতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এর আগে গত সপ্তাহে একাধিক অভিযানে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার তথ্য পায় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। কিন্তু দুদকের এমন তৎপরায় নিজেদের রক্ষা করতে তড়িঘড়ি করেই মামলা দেয়া হয়। যা অনেকটা দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবেই নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। দুদকের বিশ^স্ত সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার পেছনে শুধু কর্মচারীরাই জড়িত নয়। এর সাথে কমিশনের উধ্বর্তন কর্মকর্তারাও জড়িত রয়েছেন। যার বিষয়ে সকল তথ্য-উপাত্ত দুদকের হাতে এসে পৌঁছেছে। তবে কর্মকর্তারা নিজেদের বাঁচাতে শুধুমাত্র কয়েকজন কর্মচারীকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করেন। দুদক টিম যখন অভিযান পরিচালনা করেন, তখন তারা নিখোঁজ ল্যাপটপ এবং আইন প্রক্রিয়ার বিষয়ে কোন তথ্য দুদকে দেখাতে পারেন নি। যা প্রমাণ করে- এতে কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এছাড়াও ২০১৫ সালে ল্যাপটপটি হারালেও এতদিন পর্যন্ত কেন নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেয়নি, তাও রহস্যজনক। তবে দুদকের অভিযানের পর তড়িঘড়ি করে মামলা প্রমাণ করে তাতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জড়িত থাকার বিষয়টি আড়াল করতেই এই কাজ করেছেন বলে মনে করছেন দুদক কর্মকর্তারা।
দুদকের এক কর্মকর্তা পূর্বকোণকে বলেন, নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে ল্যাপটপ হারানোর বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি। বরং নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে দাবি করা হয়েছিল- রোহিঙ্গারা যে ল্যাপটপের মাধ্যমে ভোটার হয়েছে তা কমিশনের কোন ল্যাপটপই নয়। ৪৩৯১ ও ০৩৫১ ল্যাপটপটির বিষয়ে তথ্য চাইলেও তারা এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারেন নি। অভিযানের দু’দিন পর লিখিতভাবে জানানো হয়- রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার পেছনে এই ল্যাপটপটি ব্যবহরা করাই হয়নি। অথচ দুদকের সর্বশেষ অভিযানের একদিন পর অফিস পিয়নকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন নির্বাচন কমিশন। নিজেদের রক্ষা করতেই এমন কাজটি করা হয়েছে। মূলত নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা ফেঁসে যাওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই একদিনের মাথায় এমন কাজটি করেছেন। যা অনেকটা নাটক বলেও মন্তব্য করেন দুদকের এই কর্মকর্তা।
দুদক কর্মকর্তারা বলেন, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা নিজেদের বাঁচাতে এমন কাজ করলেও কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। যারাই এর সাথে জড়িত আছে, অনুসন্ধান করে সকলকেই আইনের আওতায় আনা হবে। দুদক চাইলে যখন তখন ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে অনুসন্ধান করে এক সাথেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
ফেঁসে যেতে পারেন যারা :
রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার পেছনে শুধুমাত্র নির্বাচন অফিস সরাসরি জড়িত থাকলেও ফেঁসে যেতে পারেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধারাও। কেননা প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে জন্ম নিবন্ধন কার্ড বা প্রত্যয়ন পত্র নিয়েই তারপর নির্বাচন কমিশনে ভোটার হতে আবেদন করতে হয়। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরাও এই কাজে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করেছেন বলেও দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে আসে। যার কারণে তাঁরাও এই কাজে সহযোগী হিসেবে ফেঁসে যেতে পারেন।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিস থেকে বাঁশখালী এলাকায় ভোটার হওয়া ৬৮ জনের (ফরম নম্বর ৪১৮৬৩৩ থেকে ৪১৮৭০১ পর্যন্ত) তালিকা দুদকের কাছে দেওয়া হয়। এই ৬৮ জনের মধ্যে মোস্তফা আলী নামে মাত্র একজন বাংলাদেশি ভোটার হলেও বাকি ৬৭ জনই ছিল রোহিঙ্গা নাগরিক। আবার এই মোস্তফা আলীই গ্রেপ্তার হওয়া জয়নালের আত্মীয় বলেও জানায় দুদক। এই ৬৮ জন ভোটার চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের ফরম (ফরম নং-২) দিয়েই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। কিন্তু এই ফরম শুধুমাত্র নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারাই দিতে পারেন। যদি এসব ফরম নকল বা জালিয়াতি করেই হতো তাহলে সেখানে কিভাবে নির্বাচন কমিশনের নম্বর দেয়া থাকে, সে বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই নির্বাচন কমিশনের।
এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘বাঁশখালীতে যারা ভোটার হয়েছেন তারা সবাই ৪৩৯১ ও ০৩৫১ নং ল্যাপটপ দিয়েই ভোটার হয়। এসকল ভোটার জেলা নির্বাচন অফিস থেকেই করানো হয়েছে। এখানে দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। এরপরও এ বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার পেছনে কক্সবাজারের সকল থানার নির্বাচন কমিশন অফিসের কর্মকর্তারা জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক। যার বিষয়ে শীঘ্রই কক্সবাজার যাওয়ার কথা জানিয়েছেন দুদক কমিশন।
এ বিষয়ে দুদক সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসের একাধিক কর্মকর্তা এর সাথে সরাসরি জড়িত। তাদের সাথে কাজ করেন টেকনাফ অফিস। সেই অফিস থেকেই কক্সবাজারের বিভিন্ন নির্বাচন অফিসে ভাগ করে পাঠিয়ে দেয় চক্রটি। এর বাইরে চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের এই চক্রটির সাথে যোগাযোগ করে কাজগুলো সম্পন্ন করা হয়।
চলবে দুদকের তদন্ত :
নির্বাচন কমিশন এ ঘটনায় জড়িত পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের অনুসন্ধান অব্যহত থাকবে। এ বিষয়ে কর্মচারী ছাড়াও কর্মকর্তাদের বিষয়েও অধিক অনুসন্ধান করবে দুদক। আর হারানো ল্যাপটপ উদ্ধার ও সর্বমোট কতজন রোহিঙ্গা এখন পর্যন্ত ভোটার হয়েছে তাও নিশ্চিত করতে চায় দুদক। এ জন্য দুদক কমিশন কক্সবাজার থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন নির্বাচন কমিশনে যাবেন।
জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশ পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন থেকে তথ্য পেয়েছি। তবে এই কাজে আর কারা জড়িত আছে, তা দেখতে প্রয়োজনে অন্য অফিসগুলোতেও অভিযান চালানো হবে। মূলহোতা যেই হোক, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। শুধু নির্বাচন অফিস নয়, এই কাজে সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনে জনপ্রতিনিধিকেও হাজির করা হবে’।