চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তথ্য ফাঁস পিয়ন জয়নালের

নাজিম মুহাম্মদ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:২৫ পূর্বাহ্ণ

দশ হাজার টাকায় ঢাকার সাগর নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্সধারী একটি ল্যাপটপ কিনেছিলেন জয়নাল আবেদীন। এক বছরের বেশি সময় ধরে সেই ল্যাপটপের মাধ্যমে বাসায় বসে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজ করতেন। জয়নালের দাবি-তার কাছে যে ল্যাপটপটি ছিলো সেটি চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস থেকে চুরি হওয়া পাঁচটি ল্যাপটপের একটিও নয়।

বাঁশখালীর দক্ষিণ জলদী গ্রামের আবদুল মোনাফের ছেলে জয়নাল নগরীর ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের পিয়ন হিসাবে কর্মরত আছেন। পিয়ন পদে চাকরি করলেও থাকতেন ফ্ল্যাট বাসায়। জেলা নির্বাচন অফিসের সরকারি ক্যামেরা, ফিঙ্গার ফ্রিন্ট স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাডসহ ভোটার নিবন্ধনে ব্যবহৃত আনুষাঙ্গিক সামগ্রী রীতিমতো বাসায় নিয়ে যেতেন জয়নাল। সেখানেই সাপ্তাহিক বন্ধের দিন রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ করতেন। জয়নালের দাবি-এক বছরের অধিক সময় ধরে তিনি রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ করছেন। নির্বাচন অফিসে আরো অনেকে আছেন। যারা চার/পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে এ কাজে জড়িত। ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিনিময়ে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হতো। দালাল আর নির্বাচন অফিসের বিভিন্নজনকে দেয়ার পর একজন রোহিঙ্গা ভোটার করার বিনিময়ে তিনি সাতহাজার টাকা করে পেতেন। যার কাছে দাম কম পাওয়া যায় দালালরা রোহিঙ্গাদের তার কাছেই নিয়ে যায়। দরদাম করেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় নিজেদের নিবন্ধন করছে। নজিবুল্লা নামে একজন দালাল জেলা নির্বাচন অফিসের উচ্চমান সহকারী আবুল খাইরের মাধ্যমে তার কাছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসতো। তার সাথে কক্সবাজারের আরো এক ব্যক্তি রয়েছেন। যাকে সবাই মাস্টার নামে চিনেন। সোমবার রাতে জয়নালসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল এসব তথ্য জানান। পিয়ন হলেও নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্সধারী ল্যাপটপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ শুরু করে ২০১৮ সাল থেকে।

জয়নাল বলেন, অফিসে কাজ করার সময় একদিন নজিবুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি তার কাছে এসে বলেন, উচ্চমান সহকারী আবুল খায়ের তাকে পাঠিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজে খায়ের জড়িত। ২০১৬ সালে খায়ের যখন বন্দর থানার নির্বাচন অফিসে কর্মরত ছিলেন সেই সময় সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছেন। আবুল খায়ের ছাড়াও আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের মোজাম্মেল, মিরসরাই নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী আনোয়ার, পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের হোসাইন পাটোয়ারি টেকনিক্যাল সপোর্টার মোস্তফা ফারুক এসব কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে দাবি করেন জয়নাল। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে দালাল নজিবুল্লার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতো আবুল খায়ের।
২০১৬-১৭ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় বন্দর এলাকায় সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছে দাবি করে জয়নাল বলেন, চন্দনাইশ ও মিরসরাই থেকে নির্বাচন অফিসের লাইসেন্সধারী যে পাঁচটি ল্যাপটপ চুরি হয়েছিলো তার কাছে থাকা ল্যাপটপটি সেই পাঁচটির একটিও নয়। সাগর নামে এক ব্যক্তি ঢাকা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে কাজ করতেন। তিনি বর্তমানে বিআরটিএতে কাজ করেন। তার কাছ থেকেই দশ হাজার টাকায় ল্যাপটপটি কিনেছিলেন।

আটকের পর সোমবার রাতে পুলিশ ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সামনে জয়নাল বলেন, মোস্তফা ফারুক নামে একজন টেকনিক্যাল সাপোর্টার রয়েছেন। তার বাড়ি ফেনীতে। নগরীর হামজারবাগে ভাড়া বাসায় থাকেন। টেকনিক্যালয় বিষয়ে পারদর্শী মোস্তফা ২০১৬ সালের শেষের দিকে কোতোয়ালী নির্বাচন অফিসে যোগদান করেন। সেই সময় নষ্ট হয়েছে দাবি করে জেলা নির্বাচন অফিস থেকে একটি ল্যাপটপ তিনি মিরসরাই নিয়ে যান। কিন্তু সেই ল্যাপটপটি তিনি নিজের কাছে রেখে দেন। নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের অনেকে বিষয়টি জানলেও ল্যাপটপটি আর খোঁজ করেনি। কেনই বা খোঁজ করেনি তাও রহস্যজনক। ফরম নম্বর পরিবর্তন করে অবৈধ ভোটার নিবন্ধিত করার অভিযোগে মোস্তফাকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছিলো কোতোয়ালি-ডবলমুরিয়ের তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার আবুদল লতিফ শেখ। মূলত সেই সময় নিজস্ব একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে মোস্তফা। চাকুরি থেকে বাদ দেয়া হলেও পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসে নিয়মিত কাজ করতেন মোস্তফা। নির্বাচন অফিসে টেকনিক্যাল সমস্যা হলে মোস্তফাকে ডাকা হতো। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সুসম্পর্ক থাকার সুবাধে কিছুদিন পর মোস্তফা ফের কাজে যোগ দেন। ২০১৮ সালে স্মার্টকার্ডের কাজ করার সময় রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অভিযোগে মোস্তফাকে আবারো চাকরি থেকে বাদ দেয় আবদুল লতিফ শেখ। কিছুদিন যেতে না যেতে মোস্তফা আবার চাকরিতে যোগ দেন। তিনি বর্তমানে বোয়ালখালী ও সন্দ্বীপে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ করছেন। মোস্তফার নিয়ন্ত্রণে ও একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট রয়েছে।

অনিয়মের অভিযোগ বার বার চাকুরি থেকে বাদ দেয়ার পরও মোস্তফার চাকরিতে ফেরা প্রসঙ্গে জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান জানান, অনিয়মের অভিযোগে মোস্তাফাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিলো। তাকে যে অভিযোগের প্রেক্ষিতে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিলো তার জন্য তিনি দায়ী নন এমনটি জানিয়ে চাকরি ফিরে পাবার আবেদন জানিয়েছিলেন। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। যার কারণে তাকে চাকরিতে রাখা হয়েছে। মোস্তফার ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন জানান, ২০১৭ সালে যোগদানের পর এ ধরনের একটি কথা আমি শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট