চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

তাৎপর্যপূর্ণ বরকতময় পবিত্র আশুরা আজ

রায়হান আজাদ

১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:১৩ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে বরকত, ফজিলতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ যেসব দিবস রয়েছে তন্মধ্যে পবিত্র আশুরা অন্যতম। আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশরুন’ থেকে উদ্গত, এর অর্থ দশ। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। এ মাসে কোন প্রকার ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করা শরিয়তে নাজায়েয বা নিষিদ্ধ। যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজগুলো হতে মাসটি পাক-পবিত্র বলে একে মাহে মহররম তথা ‘পবিত্র মাস’ বলা হয়। রাসুলে আকরাম (সা.) এ মাসে কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে কখনো যুদ্ধযাত্রায় বের হননি। ইসলামপূর্ব যুগেও এ মাসে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করত। যুগে যুগে দুনিয়ার বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও কাহিনী এ মাসে সংঘটিত হয় বলে এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব সবার কাছে স্বীকৃত। ইসলামের ইতিহাসে নানাভাবে অবিস্মরণীয় ও মহিমান্বিত এ দিবস সবদিক বিবেচনায় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

পবিত্র আশুরার দিনে মহান আল্লাহতাআলা সাগর, পাহাড়, প্রাণীকূল, আসমান-জমিন ও লওহ-কলম সৃষ্টি করেছেন। আবার এদিনেই আরশে আজিমে সমাসীন হয়েছেন। তামাম মাখলুকাত ধ্বংসও হবে কোনো এক জুমাবারে মুহররমের দশ তারিখে এই আশুরার দিনে। আল্ল­াহ পরওয়ারদেগার এ দিনে আদি পিতা হযরত আদমকে (আ.) তাঁর খলিফা নিযুক্ত করেছেন আর জান্নাতে দাখিল ও পৃথিবীতে নির্বাসনের পর মক্কায়ে মুয়াজ্জামার আরাফাত ময়দানে হযরত মা হাওয়ার সাথে পরিচিতকরতঃ দীর্ঘদিন ক্ষমা প্রার্থনাশেষে দু’জনের তাওবা কবুল করেন। পৃথিবীর প্রথম হত্যাকা- কাবিলের হাতে হাবিলের মৃত্যুর ঘটনাও আশুরার দিনে সংঘটিত হয়। হযরত নূহ (আ.) সদলবলে মহাপ্লাবন শেষে যুদী পাহাড়ে অবতরণ করে পৃথিবীকে নতুনভাবে সাজিয়ে তুলেন এ দিনে। হযরত ইব্রাহীমকে (আ.) ক্ষমতাশালী মূর্তিপূজারী নমরুদের অগ্নিকা- থেকে উদ্ধার, হযরত আইয়ুবের (আ.) কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তি, হযরত ইউনুসের (আ.) মাছের পেট থেকে পরিত্রাণ এবং ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া (আ.) এ দিনেই গ্রহণ করেন শিশুপুত্র মুসাকে (আ.)। এ দিনই হযরত দাউদের (আ.) গুনাহ মাফ হয়, কুমারী মাতা বিবি মরিয়মের (আ.) গর্ভ হতে পৃথিবীতে আগমন ঘটে হযরত ঈসার (আ.)। এ দিনই রহমত স্বরূপ আসমান হতে প্রথম বৃষ্টি নামে। পবিত্র আশুরার দিনেই হযরত সোলাইমান (আ.) তার হাতের আংটি হারিয়ে সাময়িকভাবে রাজ্যহারা হলে আল্লাহতাআলা তাকে আবার রাজ্য ফিরিয়ে দেন। হযরত ইউসূফ (আ.) তার পিতা ইয়াকুবের (আ.) সাথে সুদীর্ঘ ৪০ বৎসর পর এ দিনে সাক্ষাৎ লাভ করেন। এ দিনেই হযরত মুসা (আ.) তুর পর্বতে আল্লাহতাআলার সাথে আলাপন এবং তাওরাত কিতাব লাভ করেছিলেন। হযরত মুসা (আ.) তৎকালীন মিশরের বাদশাহ ফেরাউনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে এ দিনে তিনি বনী ইসরাঈলকে সাথে নিয়ে নীল নদ পার হয়ে যান আর নদীর মাঝ পথে পানি চাপা পড়ে ফেরাঊনের সলিল সমাধি ঘটে। হযরত ঈসাকে (আ.) আল্লাহতাআলা নিজ অনুগ্রহে এ দিনে আসমানে তুলে নেন। হযরত মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.) এর স্মৃতি বিজড়িত এ দিন ইহুদি-খ্রিস্টানদের মাঝেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের কাছে ১০ মহররম ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে মহানবীর প্রাণপ্রিয় কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা.) ও ৪র্থ খলিফা আমিরুল মুমিনীন হযরত আলীর (রা.) পুত্র ইমাম হোসাইন (রা.) সিরিয়ার বাদশাহ কুখ্যাত ইয়াজিদের অসভ্য সেনাবাহিনীর হাতে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করলে এদিন ঐতিহাসিক কারবালা দিবস হিসেবেও যথাযথ ধর্মীয় গাম্ভীর্য সহকারে উদযাপিত হয়ে আসছে।

আমাদের পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) হিযরতের পর মদিনায় এসে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে। তারা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে এদিন পালন করছে । মহানবী (সা.) জানতে পারলেন, তারা হযরত মুসা (আ.) এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য এ দিনকে বেছে নিয়েছে । হুজুরে পাক (সা.) উপলদ্ধি করলেন যে, হযরত মুসা (আ.) এর প্রতি আমাদেরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে । তাই তিনি ঐ দিনই রোজা রাখলেন এবং সাহাবীদেরও রোজা রাখতে উপদেশ দিলেন। তবে ১০ মহররমের আগে পরে একটি রোজা বাড়িয়ে দুটি রোজা রাখতে বললেন। ২য় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজার পর আশুরার রোজার মর্যাদা এখনও সর্বাধিক। আশুরার রোজা পালন সম্পর্কে হযরত সালমা বিনতে আকওয়া (রা.) বলেন, আসলাম গোত্রের এক লোককে মহানবী (সা.) এ সংবাদ ঘোষণার দায়িত্ব দিয়ে আশুরার দিন প্রেরণ করলেন যে, যারা আজ রোজা রাখেনি তারা যেন রোজা রেখে নেয়। আর যারা ইতিমধ্যে খাওয়া-দাওয়া করেছে তারা যেন রাত পর্যন্ত খাবার ও পানাহার হতে বিরত থাকে (মুসলিম শরীফ)।

আশুরার রোজাকে ইহুদিদের রোজা হতে পৃথক করার জন্য তিনি বলেছেন, তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং ইহুদিদের থেকে ব্যতিক্রম কর। আশুরার একদিন পূর্বে বা একদিন পরেও রোজা রাখ। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আমি আগামী বছর বেঁচে থাকলে নবম দিনেও রোজা রাখব ( সহীহ মুসলিম ও আবু দাউদ শরীফ)।

আশুরার দিন রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি একবছর পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’। (মুসনাদে আহমদ)

আসুন শোহাদায়ে কারবালার মহান আদর্শকে ধারন করে অন্যায়-জবরদখল, সন্ত্রাস, মিথ্যা ও প্রতারণাকে রুখে দাড়াই। হযরত ইমাম হোসাইনের (রা.) দৃঢ় প্রত্যয় ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের দীক্ষা প্রতি আশুরায় আমাদেরকে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যেকোনো আত্মত্যাগের প্রেরণায় উজ্জীবিত করলে আশুরা উদযাপন সার্থক হবে। এ কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম- ফিরে এলো আজ মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মসিয়া ক্রন্দন চাহি না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট