চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কুটির শিল্প, সোশ্যাল মিডিয়া ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

অনলাইন ডেস্ক

১৬ মে, ২০২৩ | ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

কুটির শিল্প আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিচিত। বাংলার সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন দর্শনের সরলতা ফুটে ওঠে এ ধরনের শিল্পকর্মে।

মূলত এ শিল্পের নির্মাতা বাংলার গ্রামীণ পল্লী অঞ্চলের মানুষজন। তারা এসব পণ্য উৎপাদন করে জীবিকা ও নিজেদের ব্যবহারের জন্য। কুটির শিল্পে ডিজাইন বা মোটিভে চিরাচরিত বাংলার জীবনরূপের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। সেজন্যই গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি, লতাগুল্ম, গাছপালা, নদ-নদী, চন্দ্র-সূর্য ও আসমানের লোকজ নকশা দিয়ে ভরা নৈসর্গিক গ্রামীণ দর্শনের স্বাদ পাওয়া যায় এ শিল্পকর্মে। কুটির শিল্প অঞ্চলভেদে অনেকের কাছে হস্তশিল্প, কারুশিল্প, শৌখিন শিল্প, গ্রামীণ শিল্প হিসেবেও পরিচিত। স্থানীয় চাহিদার পাশাপাশি শহরের অভিজাত, মধ্যবিত্তদের মধ্যেও কুটির শিল্পের আলাদা আবেদন রয়েছে, যা তৈরি করেছে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের ক্ষেত্র। এছাড়া কুটির শিল্পের আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে দেশীয় হস্তনির্মিত পণ্যের পরিচিতি ও রপ্তানির সম্ভাবনা রয়ে গেছে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশে শিল্প খাতে পুঁজিঘন এবং শ্রমসাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে কুটির শিল্পকে কিছু বেগ পেতে হচ্ছে, তবে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে এ শিল্পে কাজ করা হলে ভবিষ্যৎ অবশ্যই সম্ভাবনাময়।

বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় প্রযুক্তির অবদানে নতুন একটি ধারা খুঁজে পেয়েছে কুটির শিল্প। ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে ঘর থেকে বসেই প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ঘরোয়া খাদ্যসামগ্রী ও হস্তশিল্প মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। জনপ্রিয় খাদ্যপণ্যগুলো হচ্ছে ঘরোয়া আচার, ঘি, গুড়, চিড়া ভাজা, হাতে বানানো পিঠা, জ্যাম জেলিসহ নানা ধরনের দেশি ও বিদেশি শুকনো মিষ্টি খাবার। অন্যদিকে হাতে বানানো শৈল্পিক কারুকার্য সংবলিত নানা ধরনের ঘর সাজানোর জিনিসপত্র তৈরি করা হচ্ছে। যেমন ফটো অ্যালবাম, মাটি, কাপড় বা কাঠের পুতুল, কাঠের শো-পিস, ফুলদানি, নকশা করা জামা কাপড়, চাদরসহ নানা পণ্যদ্রব্য। এক কথায় বলতে গেলে ঘর সাজানোর জন্য সব ধরনের টুকিটাকি তৈরির মাধ্যমে কুটির শিল্প নতুন করে তার আবেদন শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি করতে পেরেছে।

এখানে প্রযুক্তি তাদের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করছে। অনেকেই প্রযুক্তির এসব মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিদেশেও নিজেদের পণ্য বিক্রির একটি প্লাটফর্ম পেয়েছে। তাই প্রযুক্তি খাতকে নতুন করে ব্যবহার ও বিপণনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে নতুন বাজার, যা অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে কুটির শিল্পের জন্য। তবে প্রযুক্তির সব সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহারের সঠিক উপায় না জানার কারণে অনেকেই এর সুবিধা নিতে পারছে না। তাই প্রয়োজন এক্ষেত্রে সঠিক প্রযুক্তি জ্ঞান।

মূলত যখন কোনো পণ্য ক্ষুদ্র পরিসরে বাড়িঘরে বা আশপাশে অল্প পরিমাণে তৈরি করা হয়, সেটাকে কুটির শিল্প বলে। কুটির শিল্প হলো একটি শব্দ যা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে গৃহভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে বর্ণনা করার জন্য প্রচলিত ছিল। এই শব্দটি আজকে বাড়িতে উৎপাদিত পণ্য বা পরিষেবাগুলো বোঝাতেও ব্যবহার হয়। আক্ষরিক অর্থ অনুসারে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান যা বাড়িতে অথবা বাড়ির বাইরে কোথাও স্থাপিত হতে পারে সেটাই কুটির শিল্প। কুটির শিল্পে পারিবারিক সদস্যদের শ্রম এবং পারিবারিক পরিবেশে বিদ্যুৎ ও ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার না করে হাতের সাহায্যে এসব দ্রব্য ও দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয়।

বাংলাদেশে ১৯৭৯/৮০ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ গ্রামীণ শিল্পের ওপর এক জরিপে ৬৬টি শিল্পের তালিকা তৈরি করে, যার মধ্যে ১৩টিতে এ খাতের মোট কর্মসংস্থানের ৮৭ শতাংশ নিয়োজিত ছিল। এ শিল্পগুলোর মধ্যে ছিল তাঁত শিল্প, তেল, গুড়, মৃৎশিল্প ও কামারের তৈরি পণ্য অর্থাৎ লৌহজাত পণ্য, স্বর্ণের পণ্য, কাঠের পণ্য, বাঁশ-বেতের পণ্যসামগ্রী ইত্যাদি। তবে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কুটির শিল্পেও বিবর্তন এসেছে। যেমন খাদ্যপণ্য গুড়, ঘানির তেল ইত্যাদির সঙ্গে আরো অন্যান্য পণ্য যোগ হয়েছে। কাঠের পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে বিভিন্ন আসবাবপত্র। ধাতব পণ্যের মধ্যে কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো নতুন পণ্য। আসলে গবেষণা ও হালনাগাদ উপাত্তের অভাবে কুটির শিল্পের প্রকৃত আকার এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর অবদান সম্পর্কে পুরো ধারণা পাওয়া বেশ দুষ্কর।

জাতীয় আয়ের উপাত্ত প্রকাশের সময় কুটির শিল্পের উপাত্ত সাধারণত ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে মিলিয়ে দেখানো হয়, যার ফলে জিডিপিতে কুটির শিল্পের অংশ সম্পর্কে কিছু বলা কঠিন হয়ে যায়। তবে দু-একটা উপাত্ত থেকে এ খাতের আকার সম্পর্কে আংশিক ধারণা পাওয়া যায়। ২০১১ সালে কুটির শিল্পের যে জরিপ হয় তা থেকে দেখা যায় যে সেখানে ৩০ লাখ লোক নিয়োজিত ছিল। ২০১২ সালে সম্পাদিত শিল্প জরিপ থেকে জানা যায় যে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে সে সময় নিয়োজিত ছিল মোট ৫০ লাখ লোক। এর অর্থ এই যে ২০১০ থেকে ২০১১ সালে শিল্প খাতে নিয়োজিত ৮০ লাখ লোকের মধ্যে প্রায় ৩৮ শতাংশ ছিল কুটির শিল্পে। সে সময় কুটির শিল্পে গড়ে ৩ দশমিক ৬ জন কর্মী নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা মতে, ২০২১-২২ সালে জিডিপি ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা এবং প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য বিসিকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় ২০২১-২২ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৭৬৬টি কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে। আর কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৫৮৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। উল্লিখিত বিনিয়োগের মধ্যে ব্যাংক, বিসিক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫৫ কোটি ১ লাখ টাকা, উদ্যোক্তাদের ইকুইটি হিসেবে ৭০১ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং অবশিষ্ট ৭৩২ কোটি ৬২ লাখ টাকা উদ্যোক্তাদের নিজস্ব উদ্যোগে শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগ হয়েছে। উল্লিখিত বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে মোট ৩৭ হাজার ৪৯৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।

বিভিন্ন হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে এক করে দেখা হলেও অনেক দিক থেকে কুটির শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র শিল্পের পার্থক্য রয়েছে। কুটির শিল্প স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে, অল্প বিনিয়োগ করে, পারিবারিক শ্রম ও পদ্ধতি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী পণ্য উৎপাদন করে থাকে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র শিল্পগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করে, ভাড়া করা শ্রমিক এবং শক্তিচালিত মেশিনসহ সমাজের একটি বিস্তৃত অংশের জন্য পণ্য উৎপাদন করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে কুটির শিল্পকে ব্যবহার করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামীণ বেকারত্ব নিরসনের জন্য বাংলাদেশে কুটির শিল্পের একটি শক্তিশালী জায়গা রয়েছে। সারা দেশে শত শত বছর ধরে কুটির শিল্প স্থানীয় জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে আসছে।

এছাড়া কুটির শিল্পের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে নিত্যদিন। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব কমাতে এ শিল্প ভূমিকা রাখছে, কোনো কোনো পণ্য বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। কুটির শিল্প শুধু যে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে তা নয়, এটি আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে।

আমাদের কুটির শিল্পের মন্থরগতির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, যন্ত্র শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে কুটির শিল্পের ব্যবহার কমে গেছে। যন্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়ে বেশি পণ্য উৎপাদন করা যায় বলে মূল্যও কম পড়ে। ফলে কুটির শিল্প যন্ত্র শিল্পের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের রুচির পরিবর্তনে দেশীয় কুটির শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যগুলো গুণে ও মানে সর্বোত্তম হলেও আমরা মেশিনে প্রস্তুত দ্রব্যগুলোর বাহ্যিক কারুকার্যে মুগ্ধ হয়ে সেগুলো কিনে থাকি। তৃতীয়ত, দেশি শিল্পের প্রতি আমাদের অনীহা ও রক্ষা করার মানসিকতার অভাব। চতুর্থত, বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা ও তার অবাধ আমদানি। এমন স্বার্থপরতার ফলে দেশি কুটির শিল্পগুলোয় চরম অবনতি ঘটছে। দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধির জন্য যান্ত্রিক শিল্পের পাশাপাশি কুটির শিল্পেরও উন্নয়ন অপরিহার্য। তাই কুটির শিল্প ও এর কারিগরদের রক্ষার পাশাপাশি এ শিল্পের প্রসার ও কর্মসংস্থানের জন্য মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ মূলধনস্বল্পতা কমানো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে এ শিল্পের প্রসার ঘটানো দরকার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ শিল্পের মাধ্যমে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্য ত্বরান্বিত করতে হলে কুটির শিল্পের বিদ্যমান সীমাবদ্ধ বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় বিপণন সুবিধার ব্যবস্থা করলে স্থানীয় বাজারের সঙ্গে অন্যান্য বাজারে কুটির শিল্প সম্প্রাসরণ করতে সক্ষম হবে। মনে রাখা দরকার, কুটির শিল্প শুধু কর্মসংস্থান করছে না আজ, বরং এ কুটির শিল্পকে কেন্দ্র করে নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে। নারীর অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নও সৃষ্টি করছে এ কুটির শিল্প। আমরা যথাযথ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে গেলে তাহলেই এ কুটির শিল্প হতে পারে অর্থনীতির অন্যতম শক্তিশালী শিল্প খাত। তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট