চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

প্রকাশ্যে হুমকি দিলেও আত্মহত্যাকারী শারমিনের উত্যক্তকারীদের ধরছে না পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৫ আগস্ট, ২০১৯ | ৭:০০ অপরাহ্ণ

আজও থামেনি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনুর মায়ের কান্না। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলো কিশোরী মিনু। ঘটনার ৪ বছর অতিবাহিত হলেও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে মামলার মূল আসামি মমিন হোসেন তারেকসহ অন্যরা। পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট অভিযোগ গঠনের কারণে দফায় দফায় তদন্ত কার্যক্রম পরিবর্তন ও আসামি পক্ষের হুমকি-ধমকির ফলে সন্তান হারানোর বিচার চেয়ে ভীতিকর জীবন কাটাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাদি পরিবার।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট শাহরাস্তি উপজেলার আয়নাতলী ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনু বিদ্যালয়ে বিরতির সময় শ্রেণিকক্ষে সহপাঠী বখাটে তারেকের দ্বারা উত্ত্যক্তের শিকার হয়। পরবর্তীতে উত্ত্যক্তকারী তারেকের পরিবারের সদস্যদের হাতে আবারো নাজেহাল হয়ে ক্ষোভে-অপমানে আত্মহত্যা করে শারমিন। ওই ঘটনার পর ৪ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো বিচার না হওয়ায় হতাশ শারমিনের মা শাহিদা বেগম। তবে তিনি এখনো রয়েছেন ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায়।

শারমিনের ডাক নাম মিনু। কান্না জড়িত কণ্ঠে মিনুর মা বলেন, আমি রাস্তায় বের হই না, স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলে আমার কলিজা ফেটে যায়। বিকেল হলেই মনে হয় দলবাঁধা মেয়েদের সারি থেকে ছুটে এসে স্কুল ব্যাগ খাটে ছুঁড়ে মিনু আমায় ডাকছে, ‘মা, খেতে দাও’ সে আশায় আজো তার পথ চেয়ে আছি। আমি একটু বিচার চেয়েছি, তাও আজ এটা, কাল ওটা। দোষীদের শাস্তি দেখলে আমার মিনুর আত্মা শান্তি পাবে। যাদের কারণে আমার মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো আমি তাদের বিচারের আশায় রয়েছি।

মিনুর বড়ভাই প্রবাসী শাহজাহান সোহাগ মোবাইল ফোনে জানান, আমরা ৫ ভাইয়ের একমাত্র বোন মিনু। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম মানুষের মতো মানুষ বানাতে। সেই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ও ক্যাম্পাসে নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষরূপী কিছু অমানুষের অমানবিক আচরণের কারণে পৃথিবী ছাড়তে হয় তাকে। চার বছরেও মায়ের চোখের জল শুকায়নি, ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশায় প্রতিটি প্রহর গুণছেন তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। আর অপরাধীরা দিব্যি চোখের সামনে ঘুরাফেরা করছে। চার বছরে মামলা তুলে নিতে অনেক অনুরোধ, হুমকি ও প্রলোভন পেয়েছি অথচ শুন্য বুকের হাহাকার মিটানোর জন্য এতটুকু সান্ত্বনা দেবার মতো কাউকে পাইনি।

জানা যায়, উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের পণ্ডিত বাড়ির প্রবাসী মোহাম্মদ আলীর মেয়ে শারমিন আক্তার মিনু। তাকে প্রায়ই প্রেম নিবেদন ও উত্যক্ত করতো সহপাঠী একই ইউনিয়নের সংহাই গ্রামের প্রবাসী আবু তাহেরের ছেলে তারেক। তারেক কোনোভাবে মিনুকে প্রেমে রাজি করতে না পেরে মা রূপবান বেগম ও বোন কনিকাকে সহযোগিতা করতে বলে। এ ব্যাপারে ঘটনার ৩ দিন আগে ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট সোমবার বিকেলে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ইসমাইল হোসেনের নিকট শারমিনের ছোট ভাই নয়ন মৌখিকভাবে একটি অভিযোগ দেয়। ২০ আগস্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে ইংরেজি ক্লাস চলাকালে রূপবান বেগম ক্লাসের ভেতরে ঢুকে মিনুকে দাঁড় করায়। পরে তার ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। এ প্রস্তাব মিনু প্রত্যাখ্যান করলে তারা মিনুকে অকথ্য ভাষায় বিভিন্ন প্রকার গালিগালাজ করে। পরে বিরতির সময় রূপবান বেগমের সাথে তার মেয়ে কনিকা এসে আরো অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। ওই সময় তারেক মিনুকে চড় মারে ও মুখে থুতু দেয়। উপস্থিত অন্যান্য সহপাঠীদের সামনে অপমানিত হয়ে রাগে ক্ষোভে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে যায় মিনু।

এরপর তাদের বসত ঘরের নিচ তলায় ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। পরিবারের সদস্যরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মিনুর আত্মহননের পর তার ঘর হতে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে পুলিশ। যাতে লেখা ছিলো- ‘মা, ভাইয়া, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষেরা আমাকে বাঁচতে দিল না। আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারেক, তারেকের মা ও তার বোন কণিকা। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ তোমরা নিও।’

ঘটনার পর মিনুর ভাই শাহাবুদ্দিন নয়ন পাঁচ জনের নাম উল্লেখ করে শাহরাস্তি মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় কেবল অভিযুক্ত তিনজনের মধ্যে বখাটে তারেককে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার বাদি শাহাবুদ্দিন নয়ন জানান, ধূর্ত তারেকের পরিবার অর্থের বিনিময়ে বয়স কমিয়ে ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে। তাতে তারেকের বয়স দেখানো হয় ১৭ বছর ৫ মাস ১২ দিন। অথচ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসাপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি) ডা. এম মাঈন উদ্দিনের মেডিকেল রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তারেকের বয়স ২০ বছর। এ ভুয়া জন্মসনদ দিয়ে তারেককে অপ্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে ৩২ দিন কারাবাস শেষে প্রতারণামূলক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার জামিন নেয়া হয়। কিন্তু মিনুর আত্মহত্যায় প্রধান প্ররোচনাকারী বখাটে তারেকের মা রূপবান বেগম ও তার বোন কনিকাকে আজও আটক করা হয়নি।

মরহুম আব্দুল জলিলের পুত্র তারেকের বন্ধু আবু রায়হান, ছালেহ আহমেদের পুত্র মো. শামীম হোসেন ও তারেকের বোন নুরুন্নাহার আক্তার কনিকা। এরপর গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে অভিযোগ পত্রে তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত করেছেন মর্মে তার দাখিলকৃত চার্জশিটের উপর নারাজি আবেদন করেন বাদিপক্ষ।

এরপর গত ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখ নারাজি আবেদন মঞ্জুর হয়ে মামলাটি বিজ্ঞ আদালত সিআইডিতে প্রেরণ করে। সিআইডি পুনঃতদন্ত শেষে গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আবারো তদন্তের নির্দেশ দেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ২০১৭ সালের নভেম্বরে বর্তমানে মামলাটি দুভাগে দুটি চার্জশিট প্রদান করে (যা ৬.১৮ ও ৯.১৮)। এতে তারেক, তার মা রূপবান বেগম ও বোন কণিকাকে আসামি করা হয়। তিন আসামির বিরুদ্ধে আদালত কর্তৃক চার্জগঠন হয়েছে। যা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।

মিনুর ভাই মামলার বাদি শাহাবুদ্দিন জানান, জামিনে এসে তারেক ও তার মা তাকে প্রতিনিয়ত তাদেরকে হুমকি দিয়ে আসছে। আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারেক জামিন নিয়েছে, তার মা ও বোন প্রকাশ্যে ঘুরছে। তারা জনসম্মুখে বলে বেড়াচ্ছে, মামলা শেষ হয়ে গেছে। কোনো কিছুই হবে না।

শাহাবুদ্দিন আরো জানান, নিজের বোন হারানোর ঘটনার বিচার চেয়ে এখন নিজের জীবন নিয়ে নিজেই শঙ্কায় রয়েছি। ইভটিজিং ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও জামিনে এসে বখাটে তারেক ও অন্য আসামিরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা ও বাদি পরিবারের সদস্যদের মামলা তুলে নেয়ার হুমকি মিনুর মায়ের বিচার পাওয়ার আশা ক্ষীণ করে তুলেছে। ওই ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে স্থানীয়রা।

 

পূর্বকোণ/ময়মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট