চট্টগ্রাম রবিবার, ০৬ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

দেশের ২৬ প্রজাতির গাছে কার্বন

গবেষকদের সাফল্য : কার্বন ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি

ইফতেখারুল ইসলাম

৪ মে, ২০১৯ | ৩:২০ পূর্বাহ্ণ

দেশের ২৬ প্রজাতির গাছের কার্বনের পরিমাণ নির্ণয় করেছেন গবেষকরা। এর মাধ্যমে জলাবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণ দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। বনাঞ্চলসহ সারাদেশের সব প্রজাতির গাছের কার্বনের পরিমাণ নির্ধারণশেষে জানতে পারবে বাংলাদেশ গাছের মাধ্যমে কি পরিমাণ কার্বন ধারণ করছে। তাতে বিশে^র উন্নত দেশসমূহের কাছে কার্বন ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে গাছ, বাঁশসহ প্রায় ৫০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে গাছ রয়েছে প্রায় এক হাজার প্রজাতির।
গাছের কার্বন নির্ধারণে যে গবেষণা হয়েছে তাতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ অফিসার মো. মতিয়ার রহমান। এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পূর্বকোণকে জানান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ ২০১১ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গাছের কার্বনের পরিমাণ নির্ণয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেখানে বিভিন্ন জাতের গাছের কার্বন নির্ণয় করা হয়। এটি করা হয় মূলত ডেস্ট্রাকটিভ মেথড বা গাছ কেটে সেই গাছের বিভিন্ন অংশ কেটে তা পরিমাপের মাধ্যমে কার্বনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। তবে কার্বন নির্ণয়ের জন্য আরো একটি মেথড প্রচলিত আছে। সেটি হল এলোমেট্টিক মেথড। গাছ না কেটেই করা হয়। গাছের উচ্চতা প্রশস্ততা ইত্যাদি পরিমাপ করে এটি করা হয়। এলোমেট্টিক মেথডে ডায়ামিটার এট ব্রেস্ট হাইট (ডিবিএইচ) এবং উচ্চতা জানা থাকলে গাছের বায়োমাস বের করা সম্ভব। তবে তা ওভেন ড্রাই ওয়েট হতে হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ম্যাঞ্জিয়াম গাছের (ডিবিএইচ) এবং উচ্চতার সাথে উড স্পেসিফিক গ্রাফিটি দিয়ে গুণ করলে পুরো গাছের বায়োমাস পাওয়া যাবে। ওই বায়োমাসের সাথে যে কার্বন পাওয়া যাবে তা গুণ করলে প্রতিটি গাছের কার্বনের পরিমাণ পাওয়া যাবে। এটা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ২০০৬ (আইপিসিসি) এর মেথড। তবে ডেস্ট্রাকটিভ মেথডে নিখুঁতভাবে কার্বন নির্ণয় করা যায়। আইপিসিসি গাছের কার্বনের একটি গড় পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা হল ৪৭ শতাংশ।
মূলত আইপিসিসি এর গাইডলাইনটি যাচাই করার জন্যই ডেস্ট্রাকটিভ মেথডে পরীক্ষা করা হয়েছে। এখানে দেখা গেছে যেসব গাছের গ্রোথ বেশি সেসব গাছে কার্বনের পরিমাণ বেশি। যেসব গাছের গ্রোথ কম সেসব গাছে কার্বনের পরিমাণ কম পাওয়া গেছে।
গবেষণার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি গাছ কাটার পরপর যে পরিমাণ ওজন আসবে, তার ৫০% ওভেন ড্রাই বায়োমাস ক্যালকুলেশন করে কার্বন নির্ণয় করা হয়। এই বায়োমাসের সাথে ওই প্রজাতির যে পরিমাণ কার্বন আছে তা গুণ করলে ওই গাছে কি পরিমাণ কার্বন থাকে তা নির্ণয় করা যায়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সমতলের ১৪টি গাছের কার্বনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই গবেষণা কাজ চালানো হয়। এরমধ্যে রয়েছে ম্যাঞ্জিয়াম, ইউকেলিপটাস, হাইব্রিড একাশিয়া, শাল, আগর, রাবার, রাজকড়ি, মেহগণি, টিক, লম্বু, গামারি, আকাশমণি, রেইনট্রি এবং গর্জন গাছ। যে স্থানে যে গাছটি বেশি পাওয়া যায়, সেখান থেকে বিভিন্ন বয়সের ভিত্তিতে গাছ কেটে সংগ্রহ করা হয়। গাছের বয়সের ভিত্তিতে ১ থেকে ৫ বছর, ৬ থেকে ১০ বছর, ১১ থেকে ১৫ বছর, ১৬ থেকে ২০ বছর এবং ২১ থেকে ২৫ বছর এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে বয়সভিত্তিক গাছ চিহ্নিত করে তা কেটে সংগ্রহ করা হয়। গাছের কা-, ডালপালা, পাতা ইত্যাদি আলাদা করা হয়। গাছ কাটার পর তা ল্যাবরেটরিতে এনে ৫৪০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় ইগনিশন মেথডে কার্বনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। এখান থেকেই বুঝা যায় প্রতি হেক্টর বা একরের গাছে কি পরিমাণ কার্বন থাকে। আইপিসিসি যে গাইড লাইন দিয়েছে তা ৪৭ শতাংশ দেয়া আছে। কিন্তু গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের গাছগুলিতে আইপিসিসি’র বেঁধে দেয়া গড় কার্বনের চেয়ে বেশি কার্বন আছে। আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি কার্বন পাওয়া গেছে ম্যাঞ্জিয়াম গাছে ৫৬.৩৮ শতাংশ। সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে গর্জন গাছে। এই গাছে কার্বনের পরিমাণ পাওয়া গেছে ৫২.৬৩ শতাংশ। আর একটি গাছের কার্বনের পরিমাণ নির্ণয় করা হলে একই বয়সী বাকি গাছগুলিতে কি পরিমাণ কার্বন রয়েছে তা বের করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যায়।
কার্বনের পরিমাণ নির্নয় করার মূল উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কি পরিমাণ কার্বন ট্রেডিং করতে পারবো তা জানা যাবে। আমাদের দেশে কি পরিমাণ কার্বন আছে তা যদি আমরা না জানি তাহলে উন্নতদেশসমূহের কাছ থেকে আমাদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে পারবো না।
এখন গাছ অক্সিজেন ছাড়ে আর কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। আর মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে আর কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ে। গাছ না থাকলে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার কেউ থাকবে না। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাপমাত্রা বাড়বে। খরা হবে। ঘূর্ণিঝড় হবে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসবে। গাছ যত থাকবে, কার্বন ডাই অক্সাইড তত শোষণ করবে। গাছের মধ্যে যে কার্বন থাকে সেটাই কার্বন ডাই অক্সাইড।
তিনি জানান, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য যেসব শিল্পোন্নত দেশ দায়ী তারাই কার্বন কিনবে। তারা বরং কারখানার মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন করছে। কিন্তু তারা শিল্প বন্ধ করে কখনোই গাছ লাগাবে না। তাই তারা চায় উন্নয়নশীল দেশে ক্ষতিপূরণ দিয়ে গাছ লাগাবে। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বর্তমানে কি পরিমাণ গাছ আছে, এসব গাছ কি পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে তা পরিমাপ করে তাদের জানানোর জন্য। কারণ আমাদের গাছগুলি কি পরিমাণ কার্বণ ধারণ করছে তা জানা না থাকলে আমরা দামটা আদায় করতে পারবো না। বাংলাদেশ এখনো কার্বন ট্রেডিংয়ে যেতে পারেনি। ন্যাশনাল ফরেস্ট ইনভেনটরি চলছে। সারাদেশে এটা হচ্ছে। এই কার্যক্রম সম্পন্ন হলে দেশের বনসমূহে কি পরিমাণ কার্বণ ধারণ করে এবং সমতলের গাছসমূহে মোট কি পরিমাণ কার্বন ধারণ করে তার পরিমাণ জানা যাবে।
তিনি বলেন, কার্বন ট্রেডিংয়ে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, তা হল এক প্রজাতির গাছের বাগান না করে মিশ্র প্রজাতির গাছ লাগানো। কারণ এক প্রজাতির গাছ লাগালে তা একসময় একসাথে কাটতে হবে। তাতে গাছশূন্য হয়ে পড়বে, কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার জন্য গাছ থাকবে না। আর যদি মিশ্র প্রজাতির গাছ লাগানো হয়, তাহলে একেক প্রজাতির গাছ একেক সময় কাটতে হবে। তাহলে সবসময় সবুজায়ন থাকবে। তাতে আমরা বেশি পরিমাণ কার্বন ট্রেডিং করতে পারব। যদি আমাদের গাছে কার্বনের পরিমাণ বেশি থাকে। তাহলে আমাদের প্রকৃতিটা নির্মল হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট