চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কৃষিতে পরবর্তী রাউন্ডের প্রযুক্তি কোথায়?

অনলাইন ডেস্ক

১৩ অক্টোবর, ২০২২ | ১০:৩৪ অপরাহ্ণ

সংবাদপত্রের সূত্রে জানা যায়, দেশে এখন চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি থাকছে দেড়-দুই হাজার মেগাওয়াট। রাজধানীসহ সারা দেশে স্থানভেদে প্রতিদিন গড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে পার করতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ঢাকার বাইরে মফস্বলের কোনো কোনো স্থানে তা কখনো ১০ ঘণ্টায় ওঠারও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে গ্যাস সংকটকে। খবর: যুগান্তর

জ্বালানি বিভাগ বলছে, মূল্যবৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনমতো গ্যাস সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘যতই আশাবাদী হই না কেন, এ মুহূর্তে পরিস্থিতি ভালো দেখা যাচ্ছে না। ডলারের মূল্যে, গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এবং জ্বালানি মূল্যে কোনো কমফোর্ট জোন নেই।’

বিদ্যুৎ সংকট নিছক বিদ্যুৎ সংকট নয়। সমস্যাটি কেবল বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ফ্যান চালাতে না পেরে গরমের মধ্যে হাঁসফাঁস করা নয়, কিংবা অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকা নয়; বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেক সমস্যার জন্ম দেয়। বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকলে সেচ যন্ত্রগুলো চালানো যায় না। ফলে কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়া মানে খাদ্যশস্য ও শাকসবজি উৎপাদন ব্যাহত হওয়া।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে, সমগ্র বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি হবে এবং পৃথিবীব্যাপী দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সরকারি হিসাবে ওই দুর্ভিক্ষের ফলে সাড়ে ছাব্বিশ হাজার মানুষ মৃত্যুর কবলে পতিত হয়। বেসরকারি হিসাবে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের ফলে মৃত্যুবরণ করেছিল ১৫ লাখ মানুষ। এখনো দেশে অনেক মানুষ বেঁচে আছেন, যারা চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের ভয়াল দিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ছবি যখন স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে, আমরা তখন শিউরে উঠি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি নিছক লোডশেডিংয়ের সমস্যা নয়। এর মূলে রয়েছে মারাত্মক একটি সমস্যা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম এখন বাড়তির দিকে। দাম বেশি হওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সংগ্রহ বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি সরবরাহকারী দেশগুলো। এ তথ্য পাওয়া গেছে অর্থনীতিবিষয়ক দৈনিক পত্রিকা বণিক বার্তা থেকে। বণিক বার্তা আরও জানিয়েছে, বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সময় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে এ উদ্যোগের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন বিদ্যুৎ ঘাটতি সামাল দিচ্ছে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ছয়-সাত ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে পার করতে হচ্ছে গ্রাহকদের।

এ বিষয়ে বিদ্যুতের একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ভাষ্য হলো, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে অন্তত সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার। এর মধ্যে নিয়মিতভাবে চালু রাখতে হচ্ছে ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কেন্দ্র। পূর্ণ সক্ষমতায় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হলে প্রতিদিন ১৫০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে।

কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সরবরাহ পাচ্ছে ৯০-৯৫ কোটি ঘনফুটের মতো। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। দৈনিক বণিক বার্তা বিদ্যুৎ সমস্যার মূলের দিকটা উন্মোচিত করেছে।

বিদ্যুৎ এমন একটি জ্বালানি শক্তি, যা উৎপাদনের জন্য অন্য জ্বালানির প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আণবিক শক্তি বা জলস্রোতের শক্তি বা খনিজ কয়লা বা গ্যাসের শক্তি বা সৌর শক্তির প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এসব শক্তির যে কোনো একটিকে ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুৎ আসলে একটি রূপান্তরিত শক্তি। উৎপাদন ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে বিদ্যুতের ব্যবহার আমাদের জীবন ও কাজকে অনেক সহজসাধ্য করে। সে কারণে জ্বালানি শক্তিগুলোর মধ্যে বিদ্যুতের কদর অনেক বেশি। শিল্প উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে বিদ্যুৎ একটি কাঙ্ক্ষিত শক্তির উৎস।

এ কারণে সভ্যতার সাফল্য তিলক অর্জনে এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের কোনো বিকল্প মানবজাতি সৃষ্টি করতে পারেনি। লেনিন বলেছিলেন, বলশেভিজম+ইলেকট্রিসিটি=সমাজতন্ত্র। এখানে বলশেভিজম পুরোনো শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে, এটাই কিন্তু যথেষ্ট নয়। এ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করতে হবে প্রযুক্তি। বিদ্যুৎ শক্তি প্রযুক্তিকে দৃশ্যমান করে তুলে নানা উপযোগ (Utility) সৃষ্টি করে সভ্যতার বুনিয়াদ সৃষ্টি করতে। বিদ্যুতের ভূমিকা বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অপরিহার্য করে তুলেছে। বাংলাদেশে জলশক্তি, গ্যাস দিয়ে বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এই মুহূর্তে গ্যাসের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার ফলে আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।

বেসরকারি খাতে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলো ডিজেল অথবা ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালানো হয়। দেশে একটি বড় আকারের আণবিক শক্তিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। বাংলাদেশে উচ্চমানের কয়লা পাওয়া যায় বড়পুকুরিয়াতে। কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন চলছে। কয়লার অধিকতর ব্যবহারের মাধ্যমে বেশকিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি হবে বলে দেশীয় কয়লা উত্তোলনে অগ্রগতি নেই। আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভর করে বড় ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে বাংলাদেশে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কোন কোন শক্তি ব্যবহার করা যায়, তার জন্য একটি সুস্পষ্ট স্ট্র্যাটেজি থাকা প্রয়োজন। এ প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যের জন্য সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে।

স্বাধীনতার পর দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও সন্তোষজনকভাবে কৃষি খাতে উন্নয়ন হয়েছে। এই উন্নয়নের ফলে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পাওয়া এবং কৃষিজমি হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও খাদ্যশস্য উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে।

এই প্রযুক্তি-সিড, ফার্টিলাইজার ও ওয়াটার টেকনোলজি-ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন বীজের উদ্ভাবন করছে কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষণা কেন্দ্রগুলো। সেচের জন্য পানি সরবরাহ করা হচ্ছে শ্যালো টিউবওয়েল এবং ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। রাসায়নিক সার উৎপাদন করা হচ্ছে গ্যাস দিয়ে। কৃষি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়ন না ঘটালে স্বাধীনতার সময়ে কৃষি উৎপাদন যা ছিল, সে অবস্থাতেই থেকে যেত। এমনকি উৎপাদন কমে যাওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। যদি তা-ই হতো তাহলে খাদ্যের অভাবে অনেক লোকের মৃত্যু হতো। সেরকম একটি দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় লাগে।

কৃষিতে সাধারণত আবাদি জমি স্থির থাকে। জমি বৃদ্ধি না করে উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ বৃদ্ধি করলেও কৃষি অবধারিতভাবে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধির আওতায় চলে যায়। এই বিধির কার্যকারিতা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে বীজ-সার-পানি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে। দেশের কৃষকরা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে সন্তোষজনকভাবে সাড়া দিয়েছেন। দারিদ্র্যের চাপই তাদের বাধ্য করেছে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে। আগামী এক দশক বা দুই দশক উল্লেখিত প্রযুক্তি ব্যবহারের কাঙ্ক্ষিত সুফল নাও আসতে পারে। এ জন্য এখন থেকেই ভাবতে হবে বর্তমানে ব্যবহৃত বীজ-সার-পানি প্রযুক্তিকে কীভাবে আরও ফলপ্রসূ করে তোলা যায়। অর্থাৎ কৃষিপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রথম রাউন্ড শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য কী হবে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

লেখক: ড. মাহবুব উল্লাহ্, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

পূর্বকোণ/সাফা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট