বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ২১ শতাংশই (প্রতি পাঁচজনে একজন) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, তবে আশঙ্কাজনক বিষয় হলো তাদের অধিকাংশই জানেন না যে তিনি এ রোগে ভুগছেন।

মঙ্গলবার ও বুধবার (২০-২১ সেপ্টেম্বর) ‘হাইপারটেনশন অ্যান্ড হার্ট হেলথ’ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী সাংবাদিক কর্মশালায় তারা এসব তথ্য জানান।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টিকারী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আর যারা এ রোগে ভুগছেন, তাদের অধিকাংশই জানেন না তিনি আক্রান্ত। বিশেষ করে প্রায় অর্ধেক নারী (৫১ শতাংশ) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই (৬৭ শতাংশ) জানেই না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। কিন্তু এই উচ্চ রক্তচাপ নীরবে শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

অনুষ্ঠানে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায় তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মি.মি.। রক্তচাপের মাত্রা দুইটি ভিন্ন দিনে ১৪০/৯০ মি.মি. পারদচাপ বা তার বেশি হলে বুঝতে হবে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। তবে বয়সভেদে রক্তচাপ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে।

তিনি বলেন, অধিকাংশ সময় উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হার্ট, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অঙ্গে জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কেউ যদি উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, কিন্তু চিকিৎসা না করান, তাহলে বুকে ব্যথা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্টবিট অনিয়মিত হওয়ার পাশাপাশি স্ট্রোক হতে পারে।

এসময় জিএইচএআই বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মো. রূহুল কুদ্দুস বলেন, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে প্রত্যেকেরই নিয়মিত রক্তচাপ মাপা দরকার। কারও রক্তচাপ যদি ঠিক না থাকে, তাহলে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের কিন্তু নিয়মিত একটা মেডিসিন নিতে হয়। হাইপারটেনশনেও এমনই, কেউ যদি একবার আক্রান্ত হয়, তাকেও সবসময় মেডিসিন কন্টিনিউ করতে হবে। বছরে আমাদের প্রায় দুই লাখ ৭৭ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সঠিক নিয়মে উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা, চিকিৎসাসেবা গ্রহণ এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ ও অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। একইসঙ্গে সকল হাসপাতাল এবং কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা এবং ওষুধ প্রদান নিশ্চিত করতে এ খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (এনসিডি) ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যায়, যা সকল সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি। এ ঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-যাপন যেমন- অতিরিক্ত লবণ খাওয়া পরিহার, ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়ানো, তামাক ও মদ্যপান পরিহার করা, অতিরিক্ত ওজন কমানো এবং নিয়মিত ব্যয়াম ও শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে হবে।

বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভের বরাত দিয়ে কর্মশালায় জানানো হয়, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম। এদিকে গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি- ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। দেশে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে।

এ সময় আরও জানানো হয়, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেশ কিছু নীতি ও কর্মপরিকল্পনা থাকলেও এ বিষয়ে দেশব্যাপী উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি নেই। সরকার বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে ২৫ শতাংশ কমানোর (রিলেটিভ রিডাকশন) জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

কর্মশালায় আলোচনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথের সেন্টার ফর নন কমিউনিকেবল ডিজিজ অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা, এনটিভির হেড অব নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স জহিরুল আলম, অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স- আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, কো-কনভেনর নাদিরা কিরন ও মিজান চৌধুরী, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া এবং প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।

পূর্বকোণ/এএস/পারভেজ