চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ড দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রথম অধ্যায়ের সূচনা

১৫ আগস্ট, ২০২২ | ১২:১০ অপরাহ্ণ

আবদুল মান্নান
বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর ও পরিবারের যে ১৭জন সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। অনেকে মনে করেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ব্যক্তিগত শত্রুরাই সপরিবারে হত্যা করেছিল। আসলে সেদিন ঘাতকরা শুধু একজন শেখ মুজিবকেই হত্যা করেনি, তাদের লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে হত্যা করে বাংলাদেশকে আরেকটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করা। সাময়িকভাবে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে কিছুটা হলেও সফল হয়েছিল।

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার রচিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে দল ঘোষিত ছয় দফা কেন্দ্রিক যাকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ। এই ছয় দফার মূল বিষয় ছিল পূর্ব বাংলাসহ পাকিস্তানের অপরাপর চারটি প্রদেশের সব আর্থ-সামাজিক সিদ্ধান্ত প্রাদেশিক সরকারই নেবে। কেন্দ্রের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা ও বিদেশ নীতির বিষয়গুলো ন্যস্ত থাকবে। ছয় দফায় আরো ছিল প্রত্যেক প্রদেশ তাদের প্রয়োজনে নিজস্ব আধা সামরিক বা মিলিশিয়া বাহিনীও রাখতে পারবে। বলা বাহুল্য পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র কখনো এই ছয় দফা মেনে নেয়নি। এই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুকে অসংখ্যবার কারাগারে যেতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা (তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) রুজ্জু করা হয় যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা যে শুধু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক জোট বিরোধিতা করেছে তাই নয় দলের মধ্যেও এর বিরুদ্ধে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু নেতার বিরোধিতা ছিল। দলের তৎকালীন সভাপতি পদত্যাগও করেছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল।

১৯৭০-এর নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার জন্য একটি গণপরিষদ। নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলেন রচিত সংবিধান যদি তার পছন্দ না হয় তা হলে তিনি তা বাতিল করে দেবেন, ভেঙে দেবেন গণপরিষদ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার রচিত হয়েছিল ছয় দফাকে ভিত্তি করে। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন নির্বাচনে বিজয়ী হলে সংবিধান রচিত হবে এই ইশতেহারকে ভিত্তি করে। তিনি আরো বলেছিলেন ইয়াহিয়া খানের নির্দেশনাকে তিনি টুকরো টুকরো করে বাতাসে উড়িয়ে দেবেন।

১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ১৬৯টি আসনের ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের গণপরিষদের মোট আসন ছিল তিনশ। এটি স্বাভাবিক ছিল যে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে আর শেখ মুজিব হবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। চালু হলো পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ষড়যন্ত্র। সঙ্গে যোগ দিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাঁর দল সত্তরের নির্বাচনে পেয়েছিল ৮১টি আসন। বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা যাবে তা কি আর সহ্য হয়! চললো নানা ধরনের টালবাহানা। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সব সামাল দিলেন। তিনি আজীবন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করেছেন। আওয়ামী লীগ কোনো বিপ্লবী দল নয়। ১৯৪৯ সালে গঠিত দলটি কখনো পিছনের দরজা দিয়ে অবৈধ পথে ক্ষমতায় যেতে চেষ্টা করেনি। দলের দুর্দিনে নেতা-কর্মীরা মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে। নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। কারাভোগ করেছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংঘাত অনিবার্য। তবে এই সংঘাত সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ। ২৩ বছর তো অপেক্ষা করেছে বাঙালি। এই ২৩ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে নিরন্তর শোষিতই হয়েছে। বাস্তবে পূর্ব বাংলা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ। ১৯৭০-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে প্রথম গুলিটা ছুড়লো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শুরু হলো নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। শুরু থেকেই পাকিস্তানি দালালরা ছাড়া নিরস্ত্র শান্তিকামী বাঙালি হয়ে উঠলো একটি সশস্ত্র জাতি। পাশে পেল অনেক বন্ধুপ্রতিম দেশ যাদের মধ্যে ভারত আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম। তারা পাশে এসে দাঁড়ালো সব ধরনের সহায়তা নিয়ে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মূহূর্তে বঙ্গবন্ধু বন্দী হলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। তাঁকে সামনে রেখেই বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধ চালিয়ে গেল। ১০ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে গঠিত হয়েছিল প্রবাসী সরকার যার অন্যতম সদস্য ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবন রাজনৈতিক সহচর খোন্দকার মোশতাক যিনি পরবর্তীকালে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কারিগর হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন মাঠে ময়দানে দেশকে শত্রু মুক্ত করতে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করছে আর যখন প্রবাসী সরকার আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ব্যস্ত তখন এই সরকারেরই মন্ত্রীসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য খোন্দকার মোশতাক যিনি আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি তাঁর একান্ত অনুগত আওয়ামী লীগের দলীয় একজন সংসদ সদস্য জহুরুল কাইয়ূম, আর মাহবুবুল আলম চাষী, যিনি ছিলেন একজন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের বড় মাপের আমলা, কাজ করতেন প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে, তাদের দু’জনকে সেপ্টেম্বর মাসে পাঠালেন কলকাতায় দায়িত্ব পালনরত মার্কিন কনসাল জেনারেল গ্রিফিনের কাছে এই বার্তা দিয়ে যে, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ করে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন গড়ে তুলতে চান যদি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। মোশতাক এই বার্তা পাঠান প্রবাসী সরকারের অগোচরে। যার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রু মুক্ত হলো। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে লন্ডন দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। ১২ তারিখ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন দেশের নতুন সরকার গঠিত হয়। খোন্দকার মোশতাক প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে কিন্তু তাঁকে না দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রথমে আবদুস সামাদ আজাদ ও পরে ড. কামাল হোসেনকে। তা যদি না হতো তাহলে খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে বিদেশি শক্তিকে সম্পৃক্ত করার আরো বেশি করে সুযোগ পেতেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সঙ্গে খোন্দকার মোশতাকের আগে দোসরদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কতিপয় সেনা কর্মকর্তা যারা মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই শেষ সময়ে এসে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ধারণা করা হয় তাদের পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের কথা গোড়া থেকেই অবহিত ছিলেন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া যিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ক্ষমতা দখল করে পনেরই আগস্টের হত্যার দায়মুক্তি দিয়ে বিদেশে দূতাবাসে পদায়ন করেছিলেন। সেনা ছাউনিতে গঠন করেছিলেন বিএনপি। ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে জাতিয় সংসদে খোন্দকার মোশতাকের জন্য শোক প্রস্তাব পাশ করিয়েছিলেন । অনেকে প্রশ্ন করেন বঙ্গবন্ধু কি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানতেন না? জানতেন হয়তো, তবে তা তিনি বিশ্বাস করেননি। তাঁকে বিভিন্ন মহল থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ একাধিকবার সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল, বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেননি। আরো একটি ভুল হয়তো বঙ্গবন্ধু করেছিলেন আর তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কার কী ভূমিকা ছিল তা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত না হওয়া।

বঙ্গবন্ধু ২৩ বছরের পাকিস্তানে বাঙালির স্বার্থ আদায়ের জন্য প্রায় ১৩ বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু দেশকে একটি অত্যাধুনিক সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন যার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে সবার আগে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করার কাজটি করলেন। বঙ্গবন্ধু ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিষিদ্ধ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সব রাজনৈতিক দলকে। জিয়া এই সব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে বিধৌত বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনলেন। তিনি পাকিস্তান যে একাত্তরে বাংলাদেশকে দখল করেছিল আর মুক্তিযোদ্ধারা তা মুক্ত করতে যুদ্ধ গিয়েছিল তা ভুলিয়ে দেয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর পরিবর্তে ব্যবহার করেন দখলদার বাহিনী শব্দ দুটি। এই ইতিহাস নিয়েই বাংলাদেশের অন্তত তিনটি প্রজš§ বেড়ে উঠেছে। তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে ইতিহাসের গতিটাকে আবার সামনের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা শুরু করেন। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না কারণ এই দীর্ঘ সময়ে দেশে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছে তা অনেকটা পাকিস্তানি ধাঁচের। মাঝখানে ২০০১ সালে যখন বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসেন এরপর এক এগারোর দুই বছর আবার ছন্দপতন । ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে চেষ্টা করেছেন দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু পথে পথে বাধাতো আছেই। বাধা আছে ঘরের ভিতর। বাধা আছে বাইরে। এরই মধ্যে যারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা এখন নানা নামে একত্রিত হচ্ছেন । সাথে আছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তারা । লক্ষ্য যে কোন উপায়ে সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার সরকারের বিরোধিতার নামে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা । বঙ্গবন্ধু কন্যাকে কখনো কখনো মনে হয় তিনি একজন নিঃসঙ্গ শেরপা। অসাধ্যকে সাধন করার চেষ্টা করছেন। এই মুহূর্তে বলতে হয় শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের শেষ বাতিঘর। বেঁচে থাকুন বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও
সাবেক চেয়ারম্যান বাংলাদেশ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট