চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বাংলাদেশে বন্যা

‘জলবায়ু সংকট’ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে

ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

২৩ জুন, ২০২২ | ১২:৪৪ অপরাহ্ণ

এমনিতেই বাংলাদেশ নামের ঘনবসতিপূর্ণ এ ব-দ্বীপটি বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত। দেশটি এখন যুঝছে গত এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার সাথে। গত এক শতকেরও বেশি সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে চলমান ‘সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায়’ এ পর্যন্ত কয়েক ডজন লোক মারা গেছে এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সরকার সতর্ক করেছে- এক সপ্তাহ ধরে দেশের এই অঞ্চলে পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে উঁচু থাকবে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, অতি বৃষ্টির কারণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশাল অংশ যেভাবে প্লাবিত হয়েছে তা জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফলাফল।
এই ঘনবসতিপূর্ণ ব-দ্বীপ দেশটি, বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ যেখানে ঘন ঘন বন্যার কারণে জীবিকা, কৃষি, অবকাঠামো এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়ে এবং যার প্রভাবে দরিদ্ররা দারুণভাবে ভোগান্তিতে পড়ে। বিশ্বব্যাংক ইনস্টিটিউটের ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি-ই প্রতি বছর বৃষ্টি-বন্যার ঝুঁকির সাথে বসবাস করছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার এন্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট (আইডব্লিউএফএম)- এর পরিচালক সাইফুল ইসলাম ৩৫ বছরের বন্যার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, বৃষ্টিপাত আগের চেয়ে অনেকটাই ‘অপ্রত্যাশিত’ রূপ নিয়েছে এবং ফলস্বরূপ অনেক নদীর পানি প্রায়ই বিপজ্জনক স্তরের উপরে থাকছে। গত সাত বছরে পাঁচটি বড় বন্যাক্রান্ত হয়েছে দেশ। গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা বন্যার প্রকোপ ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আর সেই বৃদ্ধিটা যদি হয় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তবে বৃষ্টি-বন্যার প্রকোপ ৬০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাবে।’ ব্রহ্মপুত্রসহ বেশ কয়েকটি নদী ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বাংলাদেশের নিচু জলাভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
কিন্তু এই বছর, ভারতের আসাম এবং মেঘালয় রাজ্যের অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি যেটা বাংলাদেশের মেঘনা এবং যমুনা নদী দিয়ে (এবং আশপাশের জলাশয়গুলো দিয়ে) প্রবাহিত হয়ে পুরেপিুরি নিষ্কাশিত হতে পারেনি; কেননা সংশ্লিষ্ট জলাভূমিগুলি ইতিমধ্যেই ‘প্রাক-বর্ষার বন্যায়’ পরিপূর্ণ হয়ে ছিল।
আইডব্লিউএফএম-এর গবেষক আশিক ইকবাল তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘বন উজাড় এবং কঠিন বর্জ্য ফেলায় বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি বহন ক্ষমতা কমে গেছে। এছাড়া, উজানে ভারতে অত্যধিক বালি ও পাথরের খনির মাটি আলগা হয়ে গেছে, যা নদীর তলদেশে নাব্যতা হ্রাস করেছে। ফলস্বরূপ, পুরো ‘সিস্টেম’ প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে। সে কারণে এই অকেজো সিস্টেমটি অল্প সময়ের মধ্যে পরপর দুটি বন্যার পানি দ্রুত নিষ্কাশন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর সিনিয়র উপদেষ্টা মমিনুল হক সরকার আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণের কথা বলেছেন। ‘বিগত বছরগুলোতে এতদঞ্চলের নদী ও জলাশয়গুলোর ধার ঘেঁষে অনেক পকেট রাস্তার পাশাপাশি কালভার্ট ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষত: অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে পানি সঠিক পরিমাণে না সরতে পেরে নদীগুলো ফুলে ওঠে।’
তাছাড়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ শহর ও গ্রামে সুরক্ষা বাঁধ নেই। তাই জলাভূমি বা নদীতে পানির স্তর বাড়তে শুরু করলে তা দ্রুত আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে এবং সেগুলোকে প্লাবিত করে। বন্যা মোকাবেলা করার জন্য, ১৯৯০ সালে একটি ‘বন্যা-নিয়ন্ত্রণ কর্ম পরিকল্পনার অংশ হিসাবে প্রধান নদীগুলির ধারে বাঁধ নির্মাণের মতো প্রচলিত পদ্ধতিগুলির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণে এরূপ কাঠামোগত ব্যবস্থা অকার্যকর।’
এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানী মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেছেন, ‘প্রাচীর দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং অবাঞ্ছিত। তবে নির্বাচিত কিছু জায়গায় (যেখানে জনসংখ্যা এবং সম্পদের উচ্চ ঘনত্ব অবস্থিত, যেমন বড় শহরগুলিতে) বন্যা-নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু জলাভূমির আধিক্যপূর্ণ অঞ্চলে এর প্রয়োজন নেই।’
খালেকুজ্জামান বলেন, বন্যা-নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের মতো দেশে স্থায়ী বেড়িবাঁধ বা পোল্ডার ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এ ধরণের ‘নিয়ন্ত্রণ’ জলাশয়গুলো থেকে নদীগুলিকে পৃথক করে দেয়, যা নদীর প্রবাহকে তীব্র করে এবং নদীর তীরে ক্ষয় ঘটায়।
জনাব খালেকুজ্জামানের মতে, ‘গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) অববাহিকার দেশগুলোকে (বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটান) সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ঠিক করা উচিত। তবে সমস্যা হল জিবিএম বেসিনের মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ভৌগলিক ভূখ-ের মধ্যে অবস্থিত। অর্থাৎ বাস্তবিকই, জিবিএম অববাহিকার সব দেশের মধ্যে সমন্বিত পানিসম্পদ চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশে বন্যা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যাবে না।’ সূত্র : আল-জাজিরা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট