চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বাজেট : নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার উৎসাহিত হবে

অনলাইন ডেস্ক

১০ জুন, ২০২২ | ৯:২৪ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কিন্তু তাতে দেশে পলিথিনের ব্যবহার কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। এবারের বাজেটে পরিবেশের জন্য এসেছে বড় দুসংবাদ। সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন পল্গাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়ক সামগ্রীর ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এতে দেশে পলিথিন ব্যাগের দাম কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে বাড়বে পলিথিনের ব্যবহার ও পরিবেশ দূষণ।

এ দিকে পরিবেশ খাতের প্রস্তাবিত বাজেট বরাবরের মতোই চমকহীন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত মোট বাজেট বরাদ্দ ১ হাজার ৫০১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। উন্নয়ন খাতে ১৮৬ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বরাদ্দকে অপ্রতুল বলছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বাড়বে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার, বাড়বে দূষণ: চলতি বছরে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশম স্থানে রয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। নদী হয়ে সাগরে যাওয়া প্লাস্টিক ও পলিথিন-দূষণে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। দেশে বছরে ১৭ হাজার টন পাতলা প্লাস্টিক ও পলিথিন মাটিতে পড়ছে। এর ৭৩ শতাংশ মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার পরামর্শ ও কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার বাজেটে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পলিথিনে সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেছেন। সব ধরনের পলিব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়ক সামগ্রীর উপর গত অর্থবছরে যে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তা এবার প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। 

এমন প্রস্তাবে হতাশা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম কোনো দেশ যেখানে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরমধ্যে বাজেটে অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের প্রস্তাব দুঃখজনক। সরকারের উচিত ছিল সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সহ-সভাপতি আব্দুল মতিন বলেন, শুল্ক প্রত্যাহার হলে পলিথিন ও প্লাস্টিকপণ্যের ব্যবহার নিশ্চিতভাবে বাড়বে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। তারা ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি বিষয়টিকে উৎসাহিত করে তাহলে বাংলাদেশ ওয়াস্ট হাব হয়ে যেতে পারে। যদিও আমাদের এখনকার গেজেটে আমদানি-রপ্তানি দুটোই নিষিদ্ধ। কিন্তু উৎসাহিত করলে বেআইনিভাবে আবর্জনা আসতে শুরু করতে পারে। তিনি বলেন, আমরা সবাই জানি যে এই পলিথিন মাটির সাথে মিশে না। পৃথিবী যতদিন থাকবে এগুলাও ততদিন থাকবে। আমরা যখন বাপা শুরু করলাম, দ্বারে দ্বারে গেছি মানুষের যাতে তারা পলিথিন ব্যবহার না করে। অথচ আজ সরকার থেকে পলিথিন ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আজকে আবার এটাই প্রমাণিত হল, আমাদের দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল পলিথিন বন্ধ করতে সক্ষম নয়। রাজনীতিবিদরা পলিথিন বন্ধের কথা শুধু বক্তৃতায় বলে, কিন্তু বাস্তবে তারা এসব বিষয় কানে তোলেন না। 

পলিথিন নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবকে বাজেটে ‘কালো দাগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লাভ দেখছে। কিন্তু এই প্লাস্টিক তাদের জন্যও ক্ষতিকর, একটা সময় তারাও এটা বুঝবে। পলিথিন ত্রিমাত্রিকভাবে আমাদের পরিবেশের ক্ষতি করে। মাটি, পানি, বায়ুকে সমানভাবে দূষণ করে। যেমন, এই পলিথিন মাছকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সেই মাছ আমরা খাই আবার। এভাবে এই পলিথিন খাদ্য শৃঙ্খলের মাঝেও চলে আসছে। এটা ২০০১ সালে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে জিনিস একবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই একই জিনিস আবার ২০২২ সালে ট্যাক্স কমানোর মাঝ দিয়ে উৎসাহিত করা তো ভালো কোনো বিষয় না। আশা করছি, সরকার রিভাইজড বাজেটে শুল্ক আগের মতো বাড়িয়ে দেবে। এর বিনিময়ে পরিবেশের ক্ষতি কমাতে বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যকে প্রমোট করা যেতে পারে। যদি এই সিদ্ধান্ত বদল করা না হয়, সেক্ষেত্রে আমরা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো থেকে কর্মসূচিতে যাব।

এ বিষয়ে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, যেটা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেটা নিষিদ্ধই থাকবে। তবে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে আমরা আলোচনা করে দেখবো।

দূষণ বাড়ে বাজেট কমে পরিবেশের: সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট জানিয়েছে, পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে দুই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেপ (ইপিআই) অনুযায়ী, চরম ঝুঁকিপূর্ণ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল একেবারে তলানিতে অর্থাৎ ১৮০তম। অথচ এ অবস্থায়ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ অপ্রতুল। সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত মোট বাজেট বরাদ্দ ১ হাজার ৫০১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এরআগে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) চেয়ে ২৫ কোটি টাকা কম। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ পেয়েছিল ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) এ বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১৭-২০১৮) তা ৭৩১ কোটি টাকা কমিয়ে করা হয় ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পরিবেশের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা করা হয়।

পরিবেশ সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমায় হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে উদাসীন, এটা বাজেট বরাদ্দেই প্রতিফলিত। পরিবেশ সংরক্ষণে মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা, লোকবল বাড়াতে বড়সড় বরাদ্দ প্রয়োজন। কেননা এখনো ব্যাপকহারে শিল্পায়ন হচ্ছে। 

পরিবেশের জন্য অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার।

 

পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট