চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কোভিড টেস্টে অজিদের ব্যাটিং বিপর্যয়

৩০ মে, ২০২২ | ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

গত বছর একটি আন্তর্জাতিক কোভিড কনফারেন্সে কোভিড নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্য নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেদিন অস্ট্রেলিয়ার সে সময়কার সাফল্যকে প্রথম ইনিংসের সাফল্য হিসেবে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে সচেতন করে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যকে চূড়ান্ত বলে অভিহিত করতে আমার আপত্তির কথা উল্লেখ করেছিলাম। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সার্বক্ষণিক সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে ২০০১ সালের ইডেন গার্ডেন টেস্টের কথাও সব কোভিডবোদ্ধাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম।
ক্রিকেটপ্রেমী পাঠকদের ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যকার উত্তেজনাকর ক্রিকেট টেস্টটির কথা মনে থাকার কথা। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ৪৪৫ রানের বড় স্কোর গড়েছিল। ভারতের প্রথম ইনিংস ১৭১ রানে গুটিয়ে গেলে ভারত ফলোঅনের মুখে পড়ে এবং অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট না করে ভারতকে ফলোঅনে বাধ্য করেন। ঠিক সে সময় রাহুল দ্রাবিড় আর ভিভিএস লক্ষণের ব্যাট ঝলসে উঠে রানের বন্যায়। ফলোঅন ইনিংসে ৭ উইকেটে ৬৫৭ রানের পাহাড় গড়ে ইনিংস ঘোষণা করে। বিরতি না পাওয়া ক্লান্ত অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের ছেলেখেলা খেলে ভারতের ইনিংস যখন শেষ হয় অস্ট্রেলিয়া তখন হরভজনের তোপের মুখে পড়ে বুঝতে পারে ভারতকে হাল্কাভাবে নিয়ে তারা কী ভুলটাই না করেছিল। নিজেদের উপর অতিমাত্রায় আস্থা, প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তার প্রতি অবজ্ঞা এবং তাদের প্রথম ইনিংসের দুর্বলতাকে চূড়ান্ত ধরে নেয়ার খেসারত হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ভারতকে ফলোঅনে বাধ্য করার পরও নিজেরা হেরে বসেছিল।
কোভিড মোকাবেলায়ও অস্ট্রেলিয়ার প্রাথমিক সাফল্য ও পরবর্তী বিপর্যয়কেও সেভাবেই মূল্যায়ণ করা যায়। কোভিড মোকাবেলার প্রথম ভাগে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও দ্বিতীয় ভাগে এসে তারা সমূহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ২০২০ সালের পুরোটা ও ২০২১ সালের তিন চতুর্থাংশ সময়জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার কোভিড সংক্রমণের হার ছিল খুবই সামান্য, মৃত্যুহার ছিল নগণ্য। অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে কঠোর লকডাউন কার্যকর, কোভিড সংক্রমিত এলাকাগুলোকে আইসোলেট করা, রাত্রিকালীন কারফিউ, মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপকতাসহ সব ধরণের স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করে এবং লকডাউন কার্যকরের কারণে কর্মচ্যুতদের ভাতার ব্যবস্থা করে অস্ট্রেলিয়া অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিল। সরকারের গৃহীত প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর সমর্থন ও স্বতস্ফূর্ততাও ছিল উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়া তার নিজের সাফল্যেরই শিকারে পরিণত হয়েছে। কমিউনিটিতে কোভিড আক্রান্ত ও মৃত্যুসংখ্যা নগণ্য হওয়ায় এবং দীর্ঘ লকডাউনের ক্লান্তিতে এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে জনসাধারণ এক পর্যায়ে কোভিডকে হাল্কাভাবে নিতে শুরু করলেন। প্রথম দুই ডোজ ভ্যাক্সিন গ্রহণের হার উল্লেখযোগ্য হওয়ায় সবাই নিজেদের যথেষ্ট সুরক্ষিত ভাবতে থাকলেন। অর্থনীতির চাকা ও কর্মসংস্থান সচল রাখার জন্য অনিবার্যভাবেই লকডাউন উঠে গেল, সামাজিক দূরত্ব বজায় ও মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনও শিথিল হয়ে পড়লো। যদিও এসব শিথিলতা এসেছে ভ্যাক্সিন পাসপোর্টের আওতায় (অর্থাৎ, এসব শিথিলতার সুযোগ গ্রহণ করতে হলে দুই ডোজ ভ্যাক্সিনের প্রমাণ থাকতে হবে), আমাদের মনে রাখতে হবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক মানুষ ভ্যাক্সিনের প্রতি সন্দেহ, অনাস্থা ও নানা কারণে নিজেদের ভ্যাক্সিনে আওতার বাইরে রেখেছেন। লকডাউন প্রত্যাহার ও স্বাস্থ্যবিধির শিথিলতার কারণে এই জনগোষ্ঠীর প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেঙ্গে পড়লো এবং তারাই ভ্যাক্সিন-পরবর্তী কোভিড তরঙ্গের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হলেন। দুই ডোজ ভ্যাক্সিন অনেক ক্ষেত্রেই কোভিড প্রতিহত করতে পারলে এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা, হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুহার কমাতে পারলেও তা শতভাগ কার্যকর এমনটি বলা যাবে না। কার্যকারিতা বহুগুণে বাড়াতে হলে প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক বুস্টার ভ্যাক্সিন। সেক্ষেত্রে অষ্ট্রেলিয়ার সাফল্য প্রথম দুই ডোজের মতো নয়। তাই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি নিñিদ্র করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক দুই ডোজ ভ্যাক্সিনের সাফল্য আবার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও কারণ ঘটিয়েছে। ভ্যাক্সিনের কারণে অনেক আক্রান্ত ব্যক্তিরই কোন উপসর্গ থাকছে না কিংবা নিতান্ত মামুলী ও স্বল্পস্থায়ী উপসর্গ থাকছে। ফলে তারা নিজেদের অজান্তেই তাদের সংস্পর্শে আসা মাস্কবিহীনদের মধ্যে কোভিড ছড়িয়ে দিচ্ছেন নীরবে। এসব বহুমুখী কারণে প্রাথমিক সাফল্যকে ছাপিয়ে আড়াই কোটি মানুষের এই দেশটিতে মৃত্যুসংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, দৈনিক সংক্রমণের হার ৫০ হাজারের ঘর ছুঁয়েছে।
ইডেন গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়ার প্রাথমিক সাফল্যের পরও চূড়ান্ত পরাজয়ের মতো কোভিডের টেস্টে (পরীক্ষায়) এই বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশসহ অন্যদেরও শেখার আছে। এটা সত্যি যে বর্তমানে বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দু’টোই আশাব্যাঞ্জকভাবে কম। তবে আমরা যদি বিষয়টিকে স্টিভ ওয়াহর মতো সুনিশ্চিত ধরে নিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা দেয়ালটি নিচু করে দেই তাহলে আমাদের বিপর্যয়ও সময়ের ব্যাপার মাত্র। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং মানুষের কর্মচ্যুতি রোধ করতে লকডাউনে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই সত্যি, কিন্তু এই অজুহাতে মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে শিথিলতা বা অনীহাও যৌক্তিক নয়। কোভিডের নিম্নগামী সূচকের কারণে বাংলাদেশেও স্বাস্থ্যবিধি পালনে ব্যাপক ঔদাসিন্য দৃশ্যমান। আমাদের বুস্টার ডোজ ভ্যাক্সিন গ্রহণের হারও আশানুরূপ নয়। ফলে যে কোন সময় আমরা আবার কোভিডব্যাপকতার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারি। এটা সত্যি যে আমাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে বুস্টার ডোজের আওতায় নিয়ে আসা সহজসাধ্য নয়। তবে মাস্কের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করা, শারীরিক দূরত্ব বজায়, ঘন ঘন স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে নতুন করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এসবে শৈথিল্য প্রদর্শনের ঝুঁকি নিয়ে জনসাধারণকে সতর্ক করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে উদ্যোগী হতে হবে।
কোভিডের প্রথমদিককার ঢেউগুলো মোকাবেলায় অস্ট্রেলিয়ার সাফল্য থেকে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের অনেক কিছু শেখার আছে। ঠিক তেমনভাবে তাদের সাম্প্রতিক বিপর্যয় থেকেও শেখার আছে শিথিলতার জন্য কেমন চরম মূল্য দিতে হয়। ইডেন গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসটি ফলাফলের নিয়ামক হয়নি, নিয়ামক হয়েছে তাদের অতি-আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিং বিপর্যয় এবং ভারতের শক্তিকে খাটো করে দেখা। কোভিড টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং বিপর্যয় থেকে আমরা যেন শিক্ষা নিতে ভুল না করি।
লেখক : পূর্বকোণের নিয়মতি লেখক। মেলবোর্ন প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট