চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির ৩ যুগ আজ

অনলাইন ডেস্ক

১৫ অক্টোবর, ২০২১ | ৩:৩৯ অপরাহ্ণ

দিন, মাস, বছর পেরিয়ে এ বছরের ১৫ অক্টোবর ‘জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি’র কষ্ট তিন যুগ পার করছে। প্রতিবার দিনটি এলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তত্কালীন আবাসিক ছাত্রদের শরীর-মনে জানান দেয় সেই রাতের কথা। মনে করিয়ে দেয়, কেমন ছিল সেই রাতের লোমহর্ষক ঘটনা। দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী আহত, বেঁচে যাওয়াদের জন্য রাতটি ছিল বিভীষিকাময়। এই রাতে হলের ছাত্ররা হারায় তাদের প্রিয় হলমেট, বন্ধু, সহপাঠীদের সঙ্গে অতিথিসহ কয়েক জন কর্মচারীকে। রাজধানীসহ দেশের জনসাধারণের নড়ে ওঠার সংবাদ ছিল এটি। ঐ সময়ের হলের আবাসিক ছাত্রদের কেউই আজও এই রাতকে ভুলতে পারে না; পারার কথাও নয়।

তখন বাজে সন্ধ্যা ৮টা থেকে সাড়ে ৮টা। আবাসিক ছাত্রদের অনেকে লাইব্রেরি থেকে, কেউ কেউ বাইরের টুকিটাকি কাজ শেষে হলে ফিরছে। অনেকে আবার রাতের খাবার শেষে ডাইনিং থেকে ফিরছে নিজের রুমে। দেশের একটি টিভি চ্যানেলে এই সময়টি ছিল জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘শুকতারা’ নাটকের প্রচার সময়। ফলে হলের বেশিসংখ্যক ছাত্র নাটকটি উপভোগ করার অপেক্ষায় ছিল হল অ্যাসেম্বলির টিভি কক্ষে। পুরো টিভি কক্ষ পূর্ণ, ভেতরে স্থানসংকুলানের অভাবে কেউ কেউ কক্ষের দরজা অব্দি দাঁড়িয়ে।

নাটকটি শুরু হয়েছে কি হয়নি! এমনি সময়ে ঘটে এক মর্মন্তুদ ঘটনা। হঠাতই দেবপাতের মতো বিকট আওয়াজে ধসে পড়ে অ্যাসেম্বলি কক্ষের ছাদ। কেঁপে ওঠে পুরো হল। মনে হয় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় কেঁপে ওঠে। মুহূর্তেই ধুলোবালি আর ছাদের ভেঙে পড়া জঞ্জালে টিভি কক্ষ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ছাদের যত সব খণ্ডবিখণ্ড লোহালক্কড়ের ফলা ও নুড়িপাথরের টুকরো ছুটে আসতে থাকে। কক্ষের ভেতরের, বাইরের কেউ অনুমানেই আনতে পারেনি ক্ষণিকে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা।

মুহূর্তেই ভেতর থেকে ভেসে আসতে থাকে বাঁচাও, বাঁচাও আহাজারি ও চাঁপা গোঙানির শব্দ। এরপর যা ঘটে, তা দেখে স্থির থাকা সম্ভব হয়নি কক্ষের বাইরে উপস্থিত কারো পক্ষেই; যেটি সম্ভব হয়নি সেই সময়ের আবাসিক ছাত্রদের একজন হিসেবে আমারও। কিছুক্ষণের জন্য সংবিত্ হারিয়ে ফেলি। সংবিত ফিরতেই বুঝতে পারলাম ভীষণ এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে টিভি কক্ষের ভেতরে।

দুর্ভাগ্যক্রমে এই দুর্ঘটনায় ছাত্র, কর্মচারী, অতিথিসহ ৩৯ জনের ঘটে মর্মান্তিক মৃত্যু। নিয়তি স্বীকারে বলি বা না বলি, সামান্য সময়ের ব্যবধানে নিজে অক্ষত থাকি এই দুর্ঘটনার হাত থেকে। আমিও নাটকের অন্য সব অ্যাপিসোডের দিনগুলোর মতোই নাটকটি উপভোগের জন্য বাইরে থেকে হলে ফিরে আসি। টিপ, টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। হলের পূর্ব দিকের গেটে রিকশা থেকে নেমে অনেকটা দৌড়েই অ্যাসেম্বলির টিভি কক্ষের দরজার সামনে এসে দাঁড়াই এবং চেষ্টা করি কক্ষের ভেতরে গিয়ে বসার জন্য। ভেতরে প্রবেশ তো দূরের কথা, দরজার সামনেই দাঁড়ানোর এতটুকু সুযোগ ছিল না। চেষ্টা করি দরজায় দাঁড়িয়ে নাটকটি দেখার। কিন্তু টিভি স্ক্রিনে কোনোমতেই কোনো কিছুই দেখার এবং শব্দ শোনার মতো অবস্থা ও উপায় কোনোটিই ছিল না।

জবির নতুন ক্যাম্পাস, মেয়াদ বাড়লেও হয়নি মাস্টারপ্ল্যান

হল-সংলগ্ন রাস্তার সব যান থমকে যায়। চারদিক থেকে শোনা যায় ‘কী হলো, কী হলো’ আওয়াজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আবাসিক হল থেকে দলে দলে ছাত্ররা জানার জন্য ছুটে আসতে থাকে। পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে যে যার মতো সাধ্য অনুসারে ভেতরে ঢোকে বন্ধুদের বের করে আনতে। অনেকে দরজাসংলগ্ন দু-একজনকে বের করে আনে। আমি নিজেও তা করি। ঠিকই মনে আছে, দু-একজনকে বের করে আনতে পারলেও অনেককেই আনতে পারিনি। দীর্ঘদিন হলে থাকার কারণে কাউকে কাউকে ভালো করেই চিনতে পারছিলাম, কিন্তু অসাধ্য ছিল তাদের বের করে আনা। দেখা মতে, অনেকের হাত বা পায়ের কোনো না কোনো অংশ লহার ফলায় আটকে আছে। সেজন্য কিছুই করা সম্ভব ছিল না।

এর মধ্যে চারদিক থেকে আসতে থাকে সবার সাহায্যের হাত, দেশের কিছু দক্ষ বাহিনীও যান্ত্রিক কৌশলে সাহায্যের চেষ্টা করে। কিন্তু অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রাত বাড়ে আর বন্ধুদের প্রাণবায়ু ক্ষীণ হতে থাকে। বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। জড়ো করা লাশ হলের শহিদ মিনারের সামনে আনা হয়। আহতদের চিকিত্সার জন্য নেওয়া হয় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে।

তিন যুগ আগের কথা। সময় পেরোলেও আজও মনে পড়ে সেই সব কথা। কিন্তু এখনো মনকে সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব হয় না, কেন বা কার বা কাদের অসাবধানতায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, নটর ডেম কলেজ এবং দুর্ঘটনার সময় জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট