চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

করোনাকালে বিয়ে একই স্কুলের ৪০ ছাত্রীর

অনলাইন ডেস্ক

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ১:৪০ পূর্বাহ্ণ

‘মেয়ের বড় শখ ছিল মেট্রিক (এসএসসি) পাস করবে, কলেজে যাবে। কিন্তু আশাটা পূরণ হলো না। মেয়ে দেখতে সুন্দর, স্কুলও বন্ধ, কখন কী হয়, ভয়ে তার বাবা বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না, মেয়েও না। স্কুল খোলা থাকলে বিয়েটা হইতো না।’

কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে এসব কথা জানালেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের ঘোগাদহ মালেকা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর মা। ওই ছাত্রী এ বছর নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও রেজিস্ট্রেশন করেনি। তার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। খবর বাংলাট্রিবিউনের।

শুধু ওই ছাত্রী নয়, করোনা মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তার ক্লাসের ২৫-৩০ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এই বিদ্যালয়ের ৮ম, ৯ম ও ১০ম শ্রেণির অন্তত ৪০ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অথচ সদর উপজেলার দুধকুমার নদ অববাহিকার ঘোগাদহ ইউনিয়নকে ‘বাল্যবিয়ে মুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছিল।

কেন এত সংখ্যক স্কুলছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হলো, তা জানতে গত শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ওই গ্রামে গিয়ে অনুসন্ধানে কথা হয় বাল্যবিয়ের শিকার স্কুলছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে।

বিয়ের পর কেমন আছে নবম শ্রেণির ওই ছাত্রী তা জানতে ঘোগাদহ বাজার থেকে পূর্বপ্রান্তে রসুলপুর গ্রামে বাবার বাড়িতে দেখা মেলে তার। ছাত্রীকে দেখে থমকে যেতে হয়। কারণ বিয়ের পর থেকে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, এ বছরের শুরুতে বিয়ে হয়েছিল। কোনোভাবেই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। বাবার জোরাজুরিতে বিয়ে করতে বাধ্য হই। স্বামী ব্যবসায়ী, পাশের ইউনিয়নের বাসিন্দা।

‘আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না। ছোট বয়সে বিয়ে হওয়ায় আমার শরীরে খুব অসুবিধা হয়। এরই মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব কষ্টে আছি। আমি চাই আর কারও যেন বাল্যবিয়ে না হয়’ উল্লেখ করেন স্কুলছাত্রী।

ছাত্রীর বাবা জানান, স্কুল বন্ধ থাকায় পারিবারিক ও সামাজিক নানা কারণে বাধ্য হয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। স্কুল খোলা থাকলে বিয়ে দিতাম না।

এই ছাত্রীর বিয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সোনালীর কুটি গ্রামের আরেক সহপাঠীর মায়ের সঙ্গে কথা হয়। এই ছাত্রীর মা বলেন, নবম শ্রেণির মেয়েকে ছয় মাস আগে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ে এখন শ্বশুরবাড়িতে। মেয়ের মেধা ভালো ছিল। মেয়েকে পড়াতে চেয়েছি। কিন্তু আর কতদিন বাড়িতে রাখবো। এক বছর ধরে স্কুল বন্ধ। তাই বিয়ে দিয়েছি। স্কুল খোলা থাকলে বিয়ে দিতাম না।’

কথা হয় বাল্যবিয়ের শিকার একই স্কুলের নবম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীর মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে স্কুল বন্ধ আছিল। মেয়ে বড় হয়া গেইছে। কখন কোন অঘটন ঘটে, এ জন্য বিয়া দিছি।’

অভিভাবকদের এমন আশঙ্কাকে অজুহাত হিসেবে দেখছেন ঘোগাদহ মালেকা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মালেক। কিশোরীদের বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের আইনগত কোনও পদ্ধতি না থাকলেও অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট কাজিদের কৌশলে এমন বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন এই প্রধান শিক্ষক।

তিনি বলেন, আমার বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ১৫১ জন শিক্ষার্থীর ১১৫ জন রেজিস্ট্রেশন করেছে। বাকি ৩৬ জনের ২৫ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। অষ্টম ও দশম শ্রেণির আরও ১৫ জন বাল্যবিয়ের শিকার। আরও কয়েকজন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে জেনেছি।

তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বাল্যবিয়ের মতো অভিশাপ লালন করছে এলাকার মানুষ। নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে কিছু শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন না করায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বিয়ে হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ে পাঠদান চালুর পর থেকে দশম শ্রেণির ২০ জন শিক্ষার্থী ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত থাকছে। আমাদের আশঙ্কা, তাদের অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে।’

অভিভাবক ও শিক্ষার্থী পর্যায়ে বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে নিয়মিত কাউন্সিলিং করা হলেও গোপনে এসব বিয়ে হচ্ছে বলে জানান এই শিক্ষক।

ঘোগাদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ৫-৬ জন কিশোরীর বিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম মন্ডল বিষয়টি অবগত নন বলে দাবি করেছেন।

ঘোগাদহ ইউনিয়নের কাজি রফিকুল ইসলাম তার এলাকায় বাল্যবিয়ে সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও এতে তার সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছেন। গোপনে এবং রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই এসব বাল্যবিয়ে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বাল্যবিয়ে পড়াই না। গোপনে এবং অনেক সময় অন্য এলাকায় নিয়ে এসব বিয়ে পড়ানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব বিয়ে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই হয়।’

স্থানীয়রা বলছেন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এবং দারিদ্র্যের কারণে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। আগের তুলনায় কিছুটা কম হলেও বাল্যবিয়ে চলমান।

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট