চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিমানবন্দরে করোনার পিসিআর পরীক্ষার অনুমোদন পেয়েছে বিতর্কিতরাও

পূর্বকোণ ডেস্ক

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ১০:২৯ অপরাহ্ণ

দেশের বিমানবন্দরগুলোতে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে করোনা পরীক্ষার আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের জন্য সাতটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর সক্ষমতা এবং পরীক্ষার মূল্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠায়। সেই সাতটিকেই অনুমোদন দেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তার মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতীতে করোনার ভুয়া সনদ দেওয়াসহ টাকার বিনিময়ে নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই পরীক্ষার ফল দেওয়ার অভিযোগ ছিল। আর একটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনায় ছিল নানা অসঙ্গতি। প্রথমে তারা র‍্যাপিড পিসিআর বললেও তাদের তা নেই এবং পরবর্তী প্রস্তাবনায় তা মোবাইল ডিভাইস উল্লেখ করে এবং খরচ বাড়িয়ে দেয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, স্টেমজ হেলথ কেয়ার (বিডি) লিমিটেড ঢাকা, সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার, এএমজেড হাসপাতাল লিমিটেড, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জয়নুল হক সিকদার ওমেন্স মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, গুলশান ক্লিনিক লিমিটেড ও ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক—এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্টেমজ হেলথ কেয়ার তিন দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপন করতে পারবে বলে জানিয়েছে। তারা নমুনা পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ করেছে দুই হাজার টাকা। সিএসবিএফ হেলথ সেন্টারের ল্যাব স্থাপনে সময় লাগবে পাঁচ দিন, নমুনা পরীক্ষার খরচ নেবে এক হাজার ৫০০ টাকা।

গত ১০ জুন বিদেশগামী যাত্রীদের করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে চারটি ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। টাকার বিনিময়ে করোনা পজিটিভ ব্যক্তিকে নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়া, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় নানা অনিয়মের কারণে এই চারটি ল্যাবে বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরমধ্যে আছে সিএসবিএফ হেলথ সেন্টার ও স্টেমজ হেলথ কেয়ার।

সে সময় অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালকের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিককালে আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে বিদেশগামী যাত্রীদের পজিটিভ রোগীকে নেগেটিভ সনদ দেওয়া, নমুনা সংগ্রহ ছাড়াই নেগেটিভ সনদ দেওয়া, প্রতারণার মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, নমুনা সংগ্রহ বুথের নামে দালাল নিয়োগের মতো বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডিএইচআইএস-২ ডাটাবেজ যাচাই ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনাকাঙ্ক্ষিত, জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং দেশের ভাবমূর্তি ভয়ংকরভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। এ অবস্থায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব ল্যাব ও এর অধীন অন্যান্য বুথ থেকে নমুনা সংগ্রহসহ বিদেশগামী যাত্রীদের আরটি-পিসিআর পরীক্ষা কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো।

এর আগে গত বছরের ১৩ জুলাই একদিনে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের করোনাভাইরাস পরীক্ষার অনুমোদন বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত আলাদা পাঁচটি চিঠিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদন বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। এরমধ্যে স্টেমজ হেলথ কেয়ারকে কাতারের ভিসা প্রত্যাশীদের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। চিঠিতে বলা হয়, ওই হাসপাতাল/ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে কোভিড-১৯ আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য আরটি-পিসিআর পরীক্ষার অনুমোদন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো।

এতে আরও বলা হয়, হাসপাতাল/ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ল্যাবরেটরি কোভিড-১৯ আরটি-পিসিআর পরীক্ষার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে আবারও অধিদফতরে অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে হবে। এছাড়া আরটি-পিসিআর ও আমদানি করা কিটের অনাপত্তিপত্র ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে নিতে হবে। অধিদফতর সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। জেকেজি হেলথ কেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির পর এই সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

অন্যদিকে ডিএমএফআর মলিকিউলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকস গত ২৯ আগস্ট বিমানবন্দরে ল্যাব বসাতে আগ্রহ প্রকাশ করে একটি প্রস্তাবনা জমা দেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। এরপর আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার। এক্ষেত্রে পত্রিকায় ‘এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ আহ্বান করা হবে। তবে সময়ক্ষেপণ হবে বলে তা দেওয়া হয়নি। অন্তত দুই ডজন প্রতিষ্ঠান আবেদন করে বিজ্ঞাপন ছাড়াই। স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের দুটি টেকনিক্যাল কমিটি করে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠান নির্ধারণে। 

৬ সেপ্টেম্বর রাতে ডিএমএফআর মলিকিউলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকসের প্রতিনিধির সঙ্গে টেকনিক্যাল কমিটি বৈঠক করে। সেখানে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, দিনে ৪ হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রস্তাবনার সমর্থনে যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছে তাতে অসঙ্গতি পাওয়া যাওয়ায় তা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয় সভায়। তাছাড়া প্রথম প্রস্তাবনায় প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষার ফি ১ হাজার ৭০০ টাকা নেবে বললেও সেদিনের সভায় জানায় তা ২ হাজার ৭০০ টাকা হবে। যদিও বাজারে কিটের মূল্য ৬০০-৭০০ টাকা। এ সময় সিদ্ধান্ত হয়, অনুমোদনের আগে টেকনিক্যাল কমিটি প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে রিপোর্ট দেবে। পরিদর্শনের পর র‍্যাপিড পিসিআর মেশিনের কথা বলা হলেও সেটি র‍্যাপিড নয় বলে জানায় টেকনিক্যাল কমিটি।    

ডিএমএফআর প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, টেকনিক্যাল কমিটি যে সুপারিশ দিয়েছে সেটার ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করা হবে। ডিএমএফআর যখন প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিল, ওখানে র‍্যাপিড আর মোবাইল এই দুটি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। টেকনিক্যাল কমিটি দেখলো তাদের র‍্যাপিড মেশিন নেই। আমরা ভাবলাম মোবাইল ডিভাইস যদি থাকে আর নতুন স্থাপনা যদি বিমানবন্দরে করা লাগে, মোবাইল ডিভাইসই বেস্ট। কিন্তু এর সঙ্গে যখন প্রশ্ন চলে এলো আরটি-পিসিআর সিস্টেমে দুই তিন ঘণ্টা লাগেই। আর দুই তিন ঘণ্টা লাগে ইমিগ্রেশনের জন্য। এটা যদি আমরা হিসাবে রাখি, তাতে এই তিন ঘণ্টার মধ্যে যত যাত্রী যায়, ২৪ ঘণ্টা না কিন্তু আমাদের ৩ ঘণ্টার হিসাব করতে হবে। অনেক সময় মাঝখানে এক ঘণ্টার মধ্যে ৮০০ যাত্রী যায়। এটা কিন্তু আমাদের হিসাবে রাখতে হবে, না হলে কোনোভাবে প্ল্যান করা যাবে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের যেহেতু প্রবাসীদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে আর দ্রুত সেটা করতে হবে, এটাই আমাদের কাছে দ্রুত মনে হলো। তারপরও কিন্তু টেকনিক্যাল কমিটি বিবেচনা করেছেন এবং বলেছেন এটা র‍্যাপিড না, সময় অনেক নেবে। আমাদের কাছে আরও কয়েকটা কোম্পানির প্রস্তাব আসে, যাদের ডিভাইস দুবাই-আবুধাবিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং আমরা সেটাই কনসিডার করবো যেটা র‍্যাপিড করতে পারে। সাতটি কোম্পানির নাম সক্ষমতা এবং খরচ অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদফতর পাঠিয়েছে। এখন একটা কোম্পানিও নির্ধারিত হতে পারে আবার একাধিক কোম্পানিও হতে পারে।

কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, এটি নির্ধারণ করবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর শুধু টেকনিক্যাল সহায়তা করবে।

এর আগে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত এবং বিতর্কিত তিন প্রতিষ্ঠানকে বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব কাগজপত্র দিয়েছিল, সেগুলো টেকনিক্যাল কমিটি দেখেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক যেদিন হয় সেখানে আবেদন করা ১৭টি প্রতিষ্ঠানই উপস্থিত ছিল। সবার সামনেই কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাদের দুটো শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কোন প্রতিষ্ঠান কত দ্রুত কাজটি করতে পারবে আর কত কম দামে করতে পারবে। এই দুই শর্তের ভিত্তিতেই ১৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে শর্টলিস্ট হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাজ ছিল প্রতিষ্ঠানগুলো কাজটি করতে পারবে কিনা দেখে দেওয়া, কিন্তু প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। আমাদের নির্ভর করতে হয়েছে কাগজপত্রের ওপরে। স্টেমজ জানিয়েছে, তারা তিন দিনের ভেতরে কাজটি করতে পারবে। আদৌ তারা পারবে কিনা জানি না, কিন্তু যখন ১৭টি প্রতিষ্ঠানের সামনে তারা এটা বলে, তখন আমাদের কোনও উপায়ই নেই যে তাকে বাদ দেবো। এরপর যদি কেউ শর্ত অনুযায়ী কাজ করতে না পারে, তারা করবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যারা ওপেন টেন্ডারে এসেছিল, তাদের মধ্যে থেকেই বাছাই করতে হয়েছে।’

অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আরও বলেন, ‘এর আগে যখন এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছিল, এরপর কাগজপত্র দেখে তাদের আবার কাজ করতে অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত তারা যদি অফিসিয়ালি ব্ল্যাকলিস্টেড থাকতো, আমরা এই কম্পিটিশন থেকে তাদের বাদ দিতে পারতাম। কিন্তু তারা তো ব্ল্যাকলিস্টেড না, কীভাবে তাদের বাদ দেবো?’ তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

পূর্বকোণ/আরআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট