চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাবাই কাছের পৃথিবী, বাবাই বটবৃক্ষ

২০ জুন, ২০২১ | ৫:৪৭ অপরাহ্ণ

ছোট্ট একটি শব্দ ‘বাবা’। কিন্তু, এই শব্দের গভীরতা অনেক। সন্তানের চোখে বাবাই হচ্ছে সবচেয়ে কাছের পৃথিবী। বাবা মানেই মাথার ওপর একটি বটবৃক্ষ। বাবা মানেই নির্ভরতা। একজন আদর্শবান বাবার কারণেই সন্তান শুনতে শেখে তার চারপাশের সৎ এবং সত্য মানুষগুলোর তৃপ্তির হাসি অপর দিকে অসততা ও মিথ্যাপুষিত জীবনের আহাজারি।

 

প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস পালন করা হয়। সে হিসেবে আজ ২০ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। তাই বাবা দিবসে বাবার প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করেছেন আমাদের কয়েকজন পাঠক- তা হুবহু তুলে ধরা হল-

 

আমার বাবা
তসলিম খাঁ

আমার বাবা মরহুম মো. নুরুল ইসলাম ছিলেন নগরীর মুরাদপুরস্থ মাঝি’র বাড়ির এক বনেদী পরিবারের কর্মঠ সন্তান। জীবিত অবস্থায় ৭ ভাই-বোন, মা-বাবার বৃহৎ সংসারে বিয়ে শাদী থেকে শুরু করে নানা কাজে দেখভাল ও হতাশার গ্ল্যানি নিয়ে আমার বাবার দিন যেত রাত আসতো। আমার বাবা ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার এলাকার মুক্তির স্বপক্ষের শক্তির অকুতোভয় মুক্তি সৈনিক। সদ্য প্রয়াত ৭১ সালের মুক্তির সৈনিক ফজল করিম, মুক্তির সৈনিক মরহুম ডাক্তার নুরুল হুদা, মরহুম বজল আহমেদ সওদাগর, মরহুম আবদুল খালেক সওদাগর, মরহুম ফারুক আজম, আবদুল মালেক, সৈয়দ হারুন, ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, মরহুম নুরুল হুদা মেম্বার, সেকান্দর আহমেদসহ অনেকের স্নেহভাজন মানুষ ছিলেন আমার বাবা।

 

বাবা বলতেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি সরাসরি অংশ না নিলেও, এলাকায় নানাভাবে মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করেছি। যাতে তাঁদের কোন ক্ষতি না হয়, কোনভাবে’। তিনি আরো বলতেন, ‘ভাই-বোন, বউ-বাচ্চা নিয়ে কত জায়গা বদল করেছি তার কোন ইয়োত্তা নেই। তার মধ্যে নানার বাড়ি চকবাজার (ঘাইস্স্যা পাড়া), শ্বশুর বাড়ি মাদারবাড়ী, নানা শ্বশুর বাড়ি পটিয়ায়ও রাত কাঁটাতে হয়েছে ভয়ে। তারপরও এলাকায় চলে আসতাম মাটির অধিকারে। দেশ রক্ষার টানে’।

 

যুদ্ধের গল্পে জীবতকালে বাবা প্রায় বলতেন, ‘তোমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে তোমাকে (তসলিম খাঁ) মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘরে রাখতে পারতাম না। তুমি ভাল করে হাঁটতে পারতে বিধায় আমার সাথে সাথে থাকতে চাইতে।’ আমার মা এখনও বলেন, ‘তসলিম যুদ্ধের সমত তুত্তুর্জ্জে হাডারা। এক্কানা ও ঘরত রাইত ন’পাইত্তেম, হালি দুরি দুরি ঘাডাত যাইতুগোই।

 

আজ বাবা নেই মনে করতেই হৃদয়টা কেমন জানি করে। বাবা তুমি ভাল থেকো পরপাড়ে।

 

লেখক: বিভাগীয় সম্পাদক, মাসিক ফটিকছড়ি

 

সন্তানের জন্য বাবার লেখা অসাধারণ এক চিঠি
মিজান খান

প্রিয় সন্তান…
আমি তোমাকে ৩ টি কারণে এই চিঠিটি লিখছি…
১। জীবন, ভাগ্য এবং দুর্ঘটনার কোন নিশ্চয়তা নেই, কেউ জানে না সে কতদিন বাঁচবে।
২। আমি তোমার বাবা, যদি আমি তোমাকে এই কথা না বলি, অন্য কেউ বলবে না।
৩। যা লিখলাম, তা আমার নিজের ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা- এটা হয়তো তোমাকে অনেক অপ্রয়োজনীয় কষ্ট পাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।

 

জীবনে চলার পথে এগুলো মনে রাখার চেষ্টা করো
১। যারা তোমার প্রতি সদয় ছিল না, তাঁদের উপর অসন্তোষ পুষে রেখোনা। কারণ তোমার মা এবং আমি ছাড়া, তোমার প্রতি সুবিচার করা কারো দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। আর যারা তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে – তোমার উচিত সেটার সঠিক মূল্যায়ন করা এবং কৃতজ্ঞ থাকা। তবে তোমার সতর্ক থাকতে হবে এজন্য যে, প্রতিটি মানুষেরই প্রতি পদক্ষেপের নিজ নিজ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। একজন মানুষ আজ তোমার সাথে ভালো- তার মানে এই নয় যে সে সবসময়ই ভালো থাকবে। কাজেই খুব দ্রুত কাউকে প্রকৃত বন্ধু ভেবো না।

 

২। জীবনে কিছুই কিংবা কেউই ‘অপরিহার্য’ নয়, যা তোমার পেতেই হবে। একবার যখন তুমি এ কথাটির গভীরতা অনুধাবন করবে, তখন জীবনের পথ চলা অনেক সহজ হবে – বিশেষ করে যখন বহুল প্রত্যাশিত কিছু হারাবে, কিংবা তোমার তথাকথিত আত্মীয়-স্বজনকে তোমার পাশে পাবেনা।

৩. জীবন সংক্ষিপ্ত। আজ তুমি জীবনকে অবহেলা করলে, কাল জীবন তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। কাজেই জীবনকে তুমি যতো তাড়াতাড়ি মূল্যায়ন করতে শিখবে, ততোই বেশী উপভোগ করতে পারবে।

 

৪. ভালবাসা একটি ক্ষণস্থায়ী অনুভূতি ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের মেজাজ আর সময়ের সাথে সাথে এই অনুভূতি বিবর্ণ হবে। যদি তোমার তথাকথিত কাছের মানুষ তোমাকে ছেড়ে চলে যায়, ধৈর্য ধরো, সময় তোমার সব ব্যথা-বিষন্নতাকে ধুয়ে-মুছে দেবে। কখনো প্রেম-ভালবাসার মিষ্টতা এবং সৌন্দর্যকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেনা, আবার ভালবাসা হারিয়ে বিষণ্ণতায়ও অতিরঞ্জিত হবে না।

 

৫. অনেক সফল লোক আছেন যাদের হয়তো উচ্চশিক্ষা ছিলনা- এর অর্থ এই নয় যে, তুমিও কঠোর পরিশ্রম বা শিক্ষালাভ ছাড়াই সফল হতে পারবে! তুমি যতোটুকু জ্ঞানই অর্জন করোনা কেন, তাই হলো তোমার জীবনের অস্ত্র। কেউ ছেড়া কাঁথা থেকে লাখ টাকার অধিকারী হতেই পারে, তবে এজন্য তাকে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে।

 

৬. আমি আশা করি না যে, আমার বার্ধক্যে তুমি আমাকে আর্থিক সহায়তা দিবে। আবার আমিও সারাজীবন ধরে তোমাকে অর্থ সহায়তা দিয়ে যাবনা। যখনি তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন বাবা হিসেবে আমার অর্থ-সহায়তা দেবার দিন শেষ। তারপর, তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তুমি কি পাবলিক পরিবহনে যাতায়াত করবে, নাকি নিজস্ব লিমুজিন হাঁকাবে; গরীব থাকবে নাকি ধনী হবে।

 

৭. তুমি তোমার কথার মর্যাদা রাখবে, কিন্তু অন্যদের কাছে তা আশা করোনা। মানুষের সাথে ভালো আচরণ করবে, তবে অন্যরাও তোমার সাথে ভালো থাকবে- তা প্রত্যাশা করবেনা। যদি তুমি এটি না বুঝতে পারো, তবে শুধু অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রণাই পাবে।

 

৮. আমি অনেক বছর ধরে লটারি কিনেছি, কিন্তু কখনও কোন পুরষ্কার পাইনি। তার মানে হলো এই যে- যদি তুমি সমৃদ্ধি চাও তবে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বিনামূল্যে কোথাও কিছু জুটবে না।

 

৯. তোমার সাথে আমি কতোটা সময় থাকবো- সেটা কোন ব্যাপার না। বরং চলো, আমরা আমাদের একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো উপভোগ করি, মূল্যায়ন করি।

 

ভালোবাসাসহ,
তোমার বাবা

বাবাটি হলেন একজন চাইল্ড সাইকোলজিষ্ট এবং হংকং-এর প্রখ্যাত টিভি সম্প্রচারকারী। তার কথাগুলো বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়োকনিষ্ঠ, বৃদ্ধ, তরুণ, শিশু, আমাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য।-সংগৃহীত

 

বাবা আমার কাছের বন্ধু
এসএম নিয়াজ মোর্শেদ

আমার বাবা আমার কাছের বন্ধু বা তার চেয়েও বেশি কিছু। বাবার ছোটকালের অনেক কিছু তার মুখে যখন শুনি তখন মনে হয় গল্পের ভাণ্ডার খুলে বসেছেন বাবা।

 

বাবা আমাকে বলতেন এভাবে, ‘আমাদের সময় আমরা সারাদিনের সময় অনুমান করতাম বেলা দেখে, রাতে সময় অনুমান করতাম আকাশ দেখে। ঘড়ি ছিলো না। আমাদের সময় তোমাদের মত পিচঢালা রোড ছিলো না, গাড়ির ব্যবস্থা ছিলো না। তোমরা তো আরামে স্কুলে গিয়েও হয়রান হয়ে যাও, আমাদের সময় আমি কাঁদামাটির রাস্তায় ৩-৪ মাইল হেঁটে স্কুলে যেতাম। অভাবের সংসারে একটা ভালো জামা পাইনি, ছেঁড়া জামা কাপড় পরে স্কুলে যেতাম। হালচাষ করে, বাড়ি এসে কোনরকমে পুকুরে ডুব দিয়ে পানিভাত আর পোড়ামরিচ ডলে দু’মুঠো খেয়ে স্কুলে ছুটতাম। মাঝে মাঝে কানের লতির মধ্যে কাঁদা লেগে থাকতো, খবরই ছিলো না। বই কেনার টাকা ছিলো না, বন্ধুদের বই ধার করে পড়তাম, খেলাধুলা আর লেখাপড়ায় আমি ভালো রেজাল্ট করতাম কষ্ট করে পড়েও। আর তুমি লেখাপড়াই করতে চাও না!’

 

বাবা আরো বলতেন, ‘আমাদের সময় ছোটবেলায় লাটিম খেলা আর ঘুড়ি উড়ানোতে কেউ পারতো না আমার সাথে। সে সময় ডাংগুলি, হা-ডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, ফুটবল কানামাছি এসব খেলা আমরা খেলতাম মাঠে। সারা গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়তো। ক্রিকেট খেলা সেই সময় এত জনপ্রিয় ছিলো না। আমাদের সময় জিনিসপত্রের দাম ছিলো পানির দর। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, মসলা সব কেনার পরও হাতে টাকা সাশ্রয় হতো। আমাদের সময় মানুষের মাঝে আন্তরিকতার অভাব ছিলো না। যা এখন নাই। নতুন ধান উঠলে নানা রকম পিঠা বানাতো তোর দাদি, যা এখন আর হয়না। তুই তো আরামপ্রিয় হয়েছিস, আমি তো রোদ, বৃষ্টি সব মাথায় নিয়ে তোর চেয়ে কম বয়সে জীবনটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, তোরা কি বুঝবি জীবনের মানে?

 

‘বাবার টাকায় খাস আর ঘুমাস। আমার আজকের অবস্থায় আসতে আমার জীবনে কি পরিশ্রম করতে হয়েছে তা তোর ধারণারও বাইরে। তুই তো এখন স্মার্টফোন চালাস। আর আমি আমাদের ছোটবেলায় ফোন কি চোখেও দেখিনি, চিঠি আসা যাওয়া হতো ডাকবাক্সতে। একটা কল করার জন্য কয়েকশো’ টাকা খরচ করতে হতো মানুষকে।

 

তখনকার সময় বিয়ে শাদীতে খুব মজা করতো মানুষজন, খরচও কম হতো, রং ঢং বেশী হতো। যা এখনকার সময় মিস করি। লেখাপড়ার বিষয়ে বাবা সবসময় আমায় বলতো যে পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে বাস্তবিক এবং মানবিকভাবে শিক্ষিত হবার চেষ্টা করো।’

 

আসলে বাবার মুখের এসব কথার বিবরণ বলে শেষ করা যাবে না। এখনো বাবা আমায় বুঝান, উপদেশ দেন জীবন চলার পথে, সেসব কথা অমৃত বাণীর মতো কানে লাগে এবং মনের গভীরে গেঁথে যায়। ভালো থাকুক সবার বাবা মা।

 

আমার বাবা
আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী

 

যাঁর কথাতে মধু আছে
যাঁর কথাতে দিক্ষা
যাঁর কথাতে শাসন আছে
যাঁর কথাতে শিক্ষা।
আদর শাসন দুটোই দিয়ে
দেন এগিয়ে তিনি
বিশ্ব সেরা মানুষ হলেন
আমার বাবা যিনি।
মা যখনই দেন বকুনি
বলেন হেসে ওরে
মা যা বলেন সবই সুধা
ভালোবেসে তোরে।
মানুষ হওয়ার মন্ত্রণা পাই
সোহাগ মাখা বুলি,
বাবা আমার স্বপ্ন ঘেরা
জীবন গড়ার তুলি।

 

লেখক: ছড়াকার

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট