চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

‘সরকার কথা রাখেনি’, ভাসানচরে থাকবে না রোহিঙ্গারা

‘আমরা ফিরে যেতে চাই’‌

পূর্বকোণ ডেস্ক  

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:৩৩ অপরাহ্ণ

বঙ্গোপসাগরের দুর্গম দ্বীপ ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকার যে বিশাল শরণার্থী শিবির নির্মাণ করেছে, সেখানে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এরই মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। অনেকেই সেখান থেকে ফিরে আসতে চাইছেন। সম্প্রতি একদল শরণার্থী সেখানে জীবিকার দাবিতে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ করেছেন। আরেক দল শরণার্থী রেশন নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। শরণার্থী শিবিরের কিছু বাসিন্দার মাধ্যমে ভাসানচরে তাদের জীবনের প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসির মোয়াজ্জেম হোসেন ।

ভাসান চরের প্রথম শিশু

হালিমার যখন প্রসব বেদনা উঠলো, তখন রাত প্রায় এগারোটা। বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে নতুন জেগে উঠা দ্বীপটিতে তার মাত্র আগের দিন এসে নেমেছেন তিনি। ‘প্রথম যেদিন এই দ্বীপে পা দেই, আমার কেমন যে লেগেছে আপনাকে বলতে পারবো না। এখানে মানুষ নেই, জন নেই। শুধু আমরা,’ বলছিলেন তিনি। সন্ধ্যার পর ভাসানচর যেন এক মৃতপুরী। তখন পর্যন্ত যে প্রায় সাত হাজার শরণার্থীকে এই দ্বীপে থাকার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, রাতে ক্যাম্পে তাদের কোলাহল থেমে যাওয়ার পর নেমে এসেছিল ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা।

হালিমা এর আগে আরও দুটি সন্তান জন্ম দেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানেন প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার পর কী ঘটতে যাচ্ছিল। ভাসানচরে অত রাতে ডাক্তার দূরে থাক, একজন নার্স বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। ‘আমার তখন নিজেকে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল। আতংকিত হয়ে আমি আল্লাহকে ডাকছিলাম।’

ক্যাম্পে নিজের রুমের মেঝেতে মাদুর পেতে বিছানা করে তাতে শুয়ে পড়লেন হালিমা। আর তার স্বামী এনায়েত দৌড়ে গেলেন তাদের ক্যাম্পেই এক রোহিঙ্গা নারীর কাছে, যার ধাত্রী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ‘সন্তান হতে সাহায্য করার কেউ না থাকলে আল্লাহ তাকে সন্তান দেবেন না, এমন কথা তো তিনি বলেননি,’ বলছিলেন হালিমা। ‘আল্লাহর হুকুম ছিল, তাই আমার বাচ্চা হয়ে গেল। আমার ভাগ্য ভালো।’

হালিমার ভাগ্য আসলেই ভালো। সেই রোহিঙ্গা ধাত্রী আরও তিন নারীকে সাথে নিয়ে হালিমার সন্তান প্রসবে সাহায্য করলেন। এটি ছিল ভাসানচরের মাটিতে জন্ম নেয়া প্রথম শিশুদের একটি।

নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি

হালিমার ক্ষেত্রে ভাসানচরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন তার স্বামী, এনায়েত। তার স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় কী ভেবে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন? ‘আমাদের বলা হয়েছিল পরিবার পিছু আড়াই কানি (এক একর) জমি দেবে, চাষবাস করে জীবন চলবে। এক জোড়া গরু-মহিষ দেবে। যতদিন চাষবাস করতে না পারছি, ততদিন সরকার খাওয়াবে। তারপর বলেছিল ঋণ দেবে, যাতে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে।’ এনায়েতের ভাষ্য অনুযায়ী ক্যাম্পের দুজন মাঝি (রোহিঙ্গাদের দলনেতা) তাকে প্রথম ভাসানচরে আসার প্রস্তাব দেয়। তারাই এসব কথা জানিয়েছিল। ‘ওরা আমাদের বলে, আমাদের কথা তোমাদের বিশ্বাস না হলে উখিয়ায় আমাদের মিটিং এ আসো। উখিয়ার মিটিং এ গেলাম। সেখানে সরকারের মোট তিনজন লোক ছিল। মাঝিরা আমাদের যা যা বলেছিল, ওরাও সেটাই বললো। আমরা এক সঙ্গে দশজন লোক সেখানে গিয়েছিলাম। তার মধ্যে আটজন ভাসানচরে আসার জন্য নাম লেখাই, দুই জন রাজী হয়নি। আমার স্ত্রীর যে বাচ্চা হবে, সেটা সরকারি লোকজন জানতো। আমার স্ত্রীর অবস্থা জেনে ওরা বলেছিল, কোন সমস্যা নেই। তাকে আমরা আরামে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।’

সেই যাত্রায় হালিমা একা নন, তার মতোই এরকম আরও অন্তত তিনজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তার স্বামী। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এদের মধ্যে একজনের শারীরিক অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে, তাকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নেয়া হয়েছিল একটি এম্বুলেন্সে করে।

বিতর্কিত প্রকল্প

ভাসানচরের এই শরণার্থী শিবির শুরু থেকেই এক বিতর্কিত প্রকল্প। বাংলাদেশ সরকার যখন কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছিল, তখন তার বিরোধিতা করেছিল জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা। তাদের মূল আপত্তি এই দ্বীপ কতটা মানব বসতির উপযোগী তা নিয়ে। ভাসানচর জেগে উঠেছে মাত্র গত দেড় দশকে, সেখানে বাংলাদেশ সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে এক লাখ শরণার্থীর জন্য বিরাট স্থাপনা গড়ে তোলার আগে পর্যন্ত কোন মানববসতিই ছিল না। বঙ্গোপসাগরের যে স্থানে এই দ্বীপটি, সেখানে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা বন্যা থেকে শরণার্থীরা কতটা নিরাপদ সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তারপরও সরকার গত বছরের মে মাস হতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করে। শরণার্থীদের জন্য এই আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করেছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমোডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগের জবাবে তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘ভাসানচরে সাইক্লোনের মতো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেরকম ভালো ব্যবস্থা আছে, আশে-পাশের কোন দ্বীপেই সেরকম ব্যবস্থা নেই। হাতিয়া, সন্দ্বীপের মানুষকেও আশ্রয় দেয়ার ক্ষমতা আছে আমাদের, যেখানে এক লাখ বিশ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।’

গত বর্ষা মওসুমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পের স্থাপনা ঘিরে যে নয় ফুট উচ্চতার বাঁধ, সেখানে চার-পাঁচ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত পানি উঠেছিল। আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি।’

এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আরও কিছু মানবাধিকার সংস্থা দাবি করেছিল, অনেক শরণার্থীকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই শিবিরে নেয়া হয়েছে। তবে প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী তা অস্বীকার করে বলেন, শরণার্থীরা সবাই নিজের ইচ্ছায় এসেছে। তিনি দাবি করেন, আরও বহু শরণার্থী ভাসানচরে আসার জন্য স্বেচ্ছায় নাম লেখাচ্ছে।

বাড়ছে অসন্তোষ

সরকারের তরফ থেকে ভাসানচরের শরণার্থীদের জীবনের যে ছবি তুলে ধরা হয়, সেটা সেখানে গিয়ে স্বাধীনভাবে যাচাই করার কোন সুযোগ এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা বা মানবাধিকার কর্মীরা পাননি। তবে এক সপ্তাহ ধরে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি যে চিত্র পেয়েছে তা বহুলাংশেই সরকারের দাবির বিপরীত। রোহিঙ্গারা বলেছেন: ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে নানা কারণে অসন্তোষ বাড়ছে, বিভিন্ন দাবিতে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভাসান চরে শ‌’খানেক রোহিঙ্গা প্রথম কোন বিক্ষোভ করেছেন। রেশন বিতরণে অনিয়মের প্রতিবাদেও কিছু শরণার্থী সম্প্রতি রেশন নিতে অস্বীকৃতি জানান। জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে বলে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের এই দ্বীপে আনা হয়েছিল, তার কিছুই রক্ষা করা হয়নি। সেখানে তারা আর থাকতে চান না, সুযোগ পেলে আগের জায়গায় ফিরে যেতে চান। অনেকে তাদের পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, জীবনে আর কখনো তারা এক হতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা তারা দেখছেন না।

দ্বীপটিতে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছেন অসুস্থ শরণার্থীরা। তাদের চিকিৎসা এবং ঔষধ-পথ্যের ন্যূনতম সুযোগও সেখানে নেই বলে জানিয়েছেন তারা।

প্রথম প্রতিবাদ

শরণার্থীদের মধ্যে ভাসান চরের পরিস্থিতি নিয়ে যে ক্ষোভ বাড়ছে তার প্রথম প্রকাশ দেখা গেছে দু’সপ্তাহ আগে। একজন শরণার্থী জানিয়েছেন, প্রতি মাসের জন্য নির্ধারিত রেশনে যে পরিমাণ খাবার দাবার দেয়ার কথা ছিল, সেদিন তার চেয়ে কম দেয়ায় কিছু মানুষ এর প্রতিবাদ জানায়। ‘রেশন নিয়েই গ-গোল হয়েছে। প্রথমে দিচ্ছিল ১৩ কেজি করে চাল। এখন দিচ্ছে ৮ কেজি করে। এটা নিয়ে গ-গোল। কিছু লোক বলেছে, আমরা রেশন খাব না, দরকার হলে উপোষ থাকবো। এরপর ওরা রেশন না নিয়ে চলে এসেছে।’

এ ঘটনার কয়েকদিন পর ভাসান চরে প্রায় শখানেক শরণার্থী আরেকটি প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করার দাবিতে। বিক্ষোভের একটি ভিডিও চিত্র বিবিসির হাতে এসেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা নারী এবং পুরুষরা উত্তেজিত ভঙ্গিতে কোথাও যাচ্ছেন। তাদের কয়েকজনের হাতে লাঠি। তাদের সঙ্গে অনেক শিশুকিশোরও রয়েছে। তবে নিরপেক্ষভাবে এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

কোয়ারেন্টিনের নামে নির্বাসন

গত বছরের মে মাসে ভাসানচরে প্রথম যাদের নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের একজন দিলারা। এই রোহিঙ্গা তরুণী তার পরিবারের আরও দুই সদস্যের সঙ্গে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রায় তিনশো রোহিঙ্গাকে বহনকারী নৌকাটি মালয়েশিয়ায় পৌছাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। বঙ্গোপসাগর থেকে মে মাসে এই শরণার্থী বোঝাই নৌকাটি উদ্ধারের পর বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখার কথা বলে নিয়ে যায় ভাসানচরে। কিন্তু দিলারার এখন মনে হচ্ছে তাকে যেন এখানে সারাজীবনের মত নির্বাসন দেয়া হয়েছে। ‘আমাদের বলেছিল, করোনাভাইরাসের কারণে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিনে রাখার জন্য আমাদের এখানে আনা হচ্ছে, ১৪ দিন পর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আনার পর থেকে এই ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখান থেকে কোথাও যেতে দিচ্ছে না। তারপর থেকে এখানেই আছি।’

বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ যা বলছে

ভাসান চরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্য অসন্তোষের খবর সরাসরি অস্বীকার করলেন বাংলাদেশ সরকারের রিফিউজি রিলিফ এন্ড রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশনার দফতরের (আরআরআরসি) প্রধান শাহ রেজওয়ান হায়াত। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখাশোনার দায়িত্ব এই সরকারী সংস্থার। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন তথ্য নেই যে তারা অখুশি।’ রোহিঙ্গার প্রতিবাদের একটি ভিডিও চিত্র বিবিসির কাছে এসেছে, একথা জানানোর পর তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক বিক্ষোভ নয়। ওরা এসেছিল মাসিক রেশন নেয়ার জন্য। ওরা রেশন নেয়ার জন্য এক সঙ্গেই আসে, গ্রুপ করে। তখন ওরা ওদের জীবিকার বিষয়টি তুলেছিল।’ শরণার্থীদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, তারা এমন কোন প্রতিশ্রুতি তাদের দেননি যে যেটা রাখা হয়নি। তিনি আরও বলেন, শরণার্থীদের জন্য সেখানে লাইভলিহুড প্রোগ্রামের আওতায় কাজের ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে। কিছু কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। অনেক দেশি এনজিও সেখানে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়ে আবেদন করেছে।-সূত্র: বিবিসি বাংলা

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট