চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দুঃসময়ে আলো ছড়িয়েছেন যারা

তাসনীম হাসান

১৯ জানুয়ারি, ২০২১ | ১২:১১ অপরাহ্ণ

গোটা বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো করোনাভাইরাস নামের অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে অসহায় হয়ে পড়া গরিব শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেক শিক্ষক। আবার কেউ কেউ এই কঠিন সময়গুলোতে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের খবর নিয়েছেন, দুশ্চিন্তামুক্ত রেখেছেন। সেই অসাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে দু’জনের গল্প পড়ুন আজ জাতীয় শিক্ষক দিবসে।

রেজাউল করিম চৌধুরী : টিউশনি বন্ধ তাতে কী? মেস ভাড়া তো আর বন্ধ নেই। পেটের ক্ষুধাও তো ঠিক আগের মতোই আছে। করোনার সময়ে টিউশনি হারিয়ে তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী কার্যত পথে বসে পড়েন। তাঁদের সেই দুঃসময়ের দিনগুলোতে পাশে পেয়েছিলেন একজন শিক্ষককে। তিনি কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম চৌধুরী।

এই শিক্ষক মহামারীর সময়ে হঠাৎ বিপদে পড়া প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীকে নগদ সহায়তা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত কর্মচারীদের পাশেও দাঁড়ান তিনি। কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের বাসায় পাঠান খাদ্যসামগ্রীও। শুধু ক্যাম্পাসে না বাইরেও নানা জায়গায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। দুটি আইসোলেশন সেন্টারের পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন বস্তিতেও আর্থিক সহায়তা দেন।

গত বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে রেজাউল করিম চৌধুরী ‘এসো মানুষের জন্য কিছু করি’ নামের একটি ফেসবুকে পেজ খুলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেন। প্রথমে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অসহায় শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে থাকেন। এরপর দেশ-বিদেশে বাস করা তাঁর বন্ধুরাও এগিয়ে আসেন এই উদ্যোগে। সবমিলিয়ে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে প্রায় ৭ লাখ টাকার সহায়তা দিয়েছেন।

কেন এমন উদ্যোগ-এমন প্রশ্নে রেজাউল করিম চৌধুরী ফিরে যান গত বছরের মার্চ মাসে। তিনি বলেন, আমাদের অসহায় শিক্ষার্থীদের দুরাবস্থার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখি। তাঁদের সেই দুঃখের বিষয়টি আমাকে খুব করে টানে। তখন থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিই।

কালাম ফেরদৌসী শান্তা : করোনার ‘অজুহাতে’ অনেকে যখন নিজের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়েন, তখন তিনি নিজ থেকেই আগ্রহ দেখান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। যোগাযোগ করতে থাকেন ফেসবুকভিত্তিক চট্টগ্রাম অনলাইন স্কুল পেজে। সেই প্রচেষ্টার ফল মেলে কয়েকদিন পরেই। দিনটি ছিল ২০২০ সালের ১৯ মে। সেদিন প্রথমবারের মতো ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়ান তিনি। এরপর থেকে শুধু এগিয়ে চলা। হাতের স্মার্টফোনটিকে কাজে লাগিয়ে তিনি এখন পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন অনলাইন স্কুলে ৬০টিরও অধিক ক্লাস নিয়েছেন। শিক্ষার্থী অন্তপ্রাণ এই অদম্য শিক্ষকের নাম কালাম ফেরদৌসী শান্তা।

এ তো গেল অনলাইনে ক্লাস করার গল্প। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর তো আর অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ নেই। সেই সব শিক্ষার্থীদের কথাও ভেবেছেন তিনি। কয়েকদিন পর পর নিজের স্কুলের অভিভাবকদের মুঠোফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খবর নেওয়ার পাশাপাশি নানা পড়া বুঝিয়ে দেন। আবার যেসব অভিভাবকের মুঠোফোন নেই? সেই সব শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চমাধ্যমিক কিংবা কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের ঠিক করে দিয়েছেন যাতে তাদের দেখভাল করেন। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর গত তিন-চার মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে একবার করে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের দুয়ারে দুয়ারে। তদারকি করছেন-তাদের শিখন কার্যক্রমের। শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষাকার্যক্রমের দিক বিবেচনা করে এখন ছন্দ শীলন নামের একটি আবৃত্তি ক্লাসে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন প্রতি শুক্রবারে।

এসব কারণে বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ সিকদারীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই সহকারী শিক্ষককে এখন সারাদেশের হাজারো শিক্ষার্থী এক নামে চেনেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও কৃতিত্ব নিতে একেবারেই নারাজ তিনি। বলেন, এই দুঃসময়ে যদি শিক্ষার্থীদের পাশেই না থাকতে পারি তবে আয়নার সামনে দাঁড়াব কী করে?

কালাম ফেরদৌসী শান্তা নিজের স্কুলের শিক্ষকদের পাশাপাশি তাঁকে এসব কার্যক্রমে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান আরও চার শিক্ষক ও বোয়ালখালী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে।

তিনি বলেন, মো. আখতার হোছাইন কুতুবী, আবদুস সোবহান, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, মোহাম্মদ ইকবাল-এই চার শিক্ষকের মাধ্যমে আমি বিভিন্ন অনলাইন স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হই। পরে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটুআইয়ের আইসিটি ফর এডুকেশন-এ জেলা এম্বাসেডর মনোনীত হই। সেখানে মানসম্মত কন্টেন্ট তৈরি করে শিক্ষক বাতায়নের সেরা কনটেন্ট নির্মাতাও হই।

এসব কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনাকালে বিভিন্নমাধ্যমেও যখন ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না তখন হতাশ হয়ে পড়ি। পরে অন্য গুণী শিক্ষকদের দেখে অনলাইনে ক্লাস করার সিদ্ধান্ত নিই।

একদিকে অনলাইন ক্লাস, অন্যদিকে শিক্ষক বাতায়নের কন্টেন্ট নির্মাণ-রাত দিন কাজের ধকল সইতে গিয়ে কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু অসুখ একটু সারতেই পুনরায় নেমে পড়েছেন পুরোদমে। নিজের মেয়েকে কখনো মায়ের কাছে, কখনো ঘুম পাড়িয়ে চালিয়ে গেছেন তাঁর কাজ। তাই কালাম ফেরদৌসী শান্তা বলেন, ‘মা পাশে না থাকলে কিছুই হতো না।

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট