চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পিবিআই গবেষণা: সাক্ষীর অভাবে ৮৫% হত্যা মামলার আসামিই খালাস

নাজিম মুহাম্মদ 

১১ জানুয়ারি, ২০২১ | ১:১০ অপরাহ্ণ

সাক্ষীর অভাবে ৮৫ শতাংশ হত্যা মামলার আসামি খালাস পেয়ে যায়। ‘বাংলাদেশে হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্তকরণ পরিস্থিতি’ নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা ১২২টি হত্যা মামলার রায় পর্যালোচনা ছাড়াও বিচারক ও  প্রসিকিউটরের সাথে কথা বলেছেন।

অভিযুক্তরা কি কি কারণে হত্যা মামলায় খালাস পায় গবেষণায় তার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কারণ দূর করতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যা মামলা তদন্ত করতে যেসব বিষয়গুলো গুরত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের সাজার হার বৃদ্ধি পাবে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা বিশেষ করে মামলা তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তাদের সমস্যা সম্পর্কে উপলদ্ধি বৃদ্ধিতে এসব সুপারিশ সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পিবিআইয়ের গবেষণায় উঠে আসা তথ্য মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। প্রতিবেদনে একটি কপি এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে।

খালাস পাওয়ার কারণ :

সাক্ষী সম্পর্কিত কারণ- যেমন, ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল না, বাদি অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে পারেনি, সাক্ষীরা ঠিকমতো সাক্ষ্য দিতে পারেনি অথবা সাংঘর্ষিক সাক্ষ্য দিয়েছে, কোন সাক্ষী অভিযুক্তদের নাম উল্লেখ করেনি, সাক্ষীদের বৈরি ঘোষণা করা হয়েছে, সাক্ষীরা সব বাদির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি, সব সাক্ষী আদালতে হাজির হয়নি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এজাহার সমর্থন করেনি। আপোষ হয়েছে, প্রসিকিউশন, বাদিপক্ষ আসামি, সাফাই সাক্ষীদের জেরা করেনি, তদন্তে ভুল-ত্রুটি, টিআই প্যারেড হয়নি, আলামত জব্দ ঠিকমত হয়নি, জব্দে ক্রটি ছিল, মামলা মিথ্যা, আইও বুঝতে পারেনি, ভুল করে চার্জশিট দিয়েছে, লাশ উদ্ধার হয়নি, তদন্তে রিপোর্ট ভুল, মোটিভ নেই, সাক্ষ্য ঠিকমত হয়নি, স্কেচ ম্যাপ নেই, সিজার লিস্ট নেই, জবানবন্দি নেই, সঠিক ধারায় মামলা হয়নি, জবানবন্দি ঠিকমতো নেয়া হয়নি, ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যদের আসামি করা হয়েছে, মামলা ভুলভাবে রেকর্ড করা হয়েছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা উল্লেখিত, আইও হত্যা চার্জশিট দেয়, মেডিকেল অফিসার ও আইও রিপোর্ট সাংঘর্ষিক, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ নেই অথবা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, ডাক্তারের সাক্ষ্য নেই, এজাহারে আসামিদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, এজাহারে ভুল তথ্য ছিলে যেমন তারিখ ভুল, এজাহারে কি ছিল বাদি জানে না শুধু সাক্ষর দিয়েছে, এজাহারকারী মারা গেছে, আসামির স্বীকারোক্তিতে ঘটনায় জড়িত উল্লেখ নেই, অন্যদের নাম দিয়েছে, জবানবন্দি যথাযথ না হওয়ায় আদালত গ্রহণ করেনি।

এসব বিষয়গুলো কি কারণে ঘটে তা জানতে ২৮টি কারণ শনাক্ত করেছে  পিবিআই। তা হলো, অদক্ষ কর্মকর্তা, তদন্ত কর্মকর্তার সততার অভাব, এজাহার, সুরতহাল, ব্যবহৃত অস্ত্র, ময়নাতদন্তের মধ্যে অমিল থাকা, মৌখিক সাক্ষের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দেয়া, তদন্তে দীর্ঘসময় লাগা, তদন্তে প্রযুক্তি ব্যবহার না করা, ১৬১ ও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি না থাকা, প্রত্যক্ষ সাক্ষী আদালতে হাজিরে ব্যর্থতা, উপর্যুক্ত সাক্ষী নির্বাচন না করা, সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে, সাক্ষীদের কোন প্রণোদনা না থাকা, আসামিদের ভয়ে সাক্ষীর সত্য সাক্ষ্য না দেয়া, বিচারকালে যথাযথভাবে সাক্ষী উপস্থাপন করতে না পারা, আলামত জব্দ বা আদালতে উপস্থাপনে ব্যর্থ হওয়া, আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হলে নানা কৌশলে খালাস পেয়ে যায়, তদন্তকারী কর্মকর্তার অদক্ষতা, বিশেষজ্ঞ মতামত ভিন্ন হলে, আপোষ হয়ে যাওয়া, বিচারে দীর্ঘ সময়ে বাদি পক্ষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যথাযথ না হওয়া, প্রসিকিউশনের গাফিলতির কারণ, বাদিপক্ষ আর্থিক অক্ষমতায় ভালো আইনজীবী দিতে না পারা, মূল দোষীদের ছাড়াও অন্যদের আসামি করা ও আসামিদের জামিনে পরবর্তী অপতৎপরতা।

আসামির দণ্ড নিশ্চিত করতে যা প্রয়োজন: আসামির দণ্ড নিশ্চিত করতে ৪০টি পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে গবেষণায়। তা হলো- নির্ভুল এজাহার দায়ের, সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রমাণ, তদন্ত কর্মকর্তাদেরকে আইনি বিষয়গুলোতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, তদন্ত কর্মকর্তার সকল লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করা, ক্রাইম সিন সংরক্ষণ করা, দ্রুত তদন্ত শেষ করা, স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে দেয়া, তদন্ত কর্মকর্তাকে সাহায্য করতে টিম গঠন করা, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রসিকিউশন, চিকিৎসক ও অন্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে টিম সভা করা, নির্ভুল তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া, পিবিআইকে আরো শক্তিশালী করা, আসামিদের গ্রেপ্তার করা, দায়িত্বশীল নিবেদিত ও স্থায়ী প্রসিকিউশন টিম, প্রসিকিউশনের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা, সঠিক সাক্ষী নির্বাচন করা, সঠিকভাবে আলামত সংগ্রহ করা, ভিডিও, অডিও রেকর্ডিং ও দালিলিক প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা, সাক্ষী উপস্থাপনে সময় না নেয়া, সাক্ষীর সুরক্ষা ব্যবস্থা করা, সাক্ষীদের লিখিত জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করা, সাক্ষীদের উপযুক্তভাবে প্রস্তুুত করা যাতে তারা জেরার মুখে দৃঢ় থাকতে পারে, সাক্ষীদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, বাদি পক্ষের আস্থা অর্জন করা, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিচারক ও উপর্যুক্ত সংখ্যক মামলা, হত্যা মামলা নিরবচ্ছিন্নভাবে শুনানির ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদলত স্থাপন, বিচারকদের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া, বিচারকাল নির্দিষ্ট করে দেয়া, বিচারকদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষেল সমন্বয়সাধন, এজাহার দায়ের থেকে রায় প্রদান পর্যন্ত মামলা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, উচ্চ আদালত প্রদত্ত নির্দেশনা মতে সিআরপিসি সংশোধন করা, আসামি যাতে জামিন না পায় তার ব্যবস্থা করা ও সততা-নিরপেক্ষতা বজায় রাখা।

বিচারকের মতামত :

হত্যা মামলার আসামিদের বেকসুর খালাস পাওয়ার কারণ বের করা গবেষণার মূল কারণ ছিলো। কারণগুলো চিহ্নিত করতে বিচারক ও প্রসিকিউটরদের অনুরোধ করা হয়েছিলো। বিজ্ঞ বিচারকরা যা মতামত দিয়েছেন তা হলো, প্রসিকিউশনের অনভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্বের অভাব (অস্থায়ী নিয়োগ অন্যতম কারণ), আদালতে সাক্ষীদের সঠিকভাবে সাক্ষ্য উপস্থাপনে ব্যর্থতা তথা মামলা প্রমাণে ব্যর্থতা, বাদি বিবাদি অপোষের কারণে, প্রসিকিউশন প্রভাবশালী দ্বারা প্রভাবিত হয়, এজাহারকারী দরিদ্র হলে সাক্ষীদের আদালতে আনতে পারেনা, মামলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রসিকিউশন দক্ষতার সাথে মনিটরিং করতে পারে না, দক্ষ প্রসিকিউশন টিম গঠন করে সকল তথ্য ও আইনগত সকল বিষয় সামঞ্জস্য আছে কি না তা দেখা ব্যবস্থা নেই, মামলা দ্রুত নিস্পত্তি না হওয়া, সাক্ষী অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে ও পিপি মাঝে মাঝে বাদি ও বিবাদির মধ্যে আপোষে ভূমিকা রাখে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট