চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ঢাকা-চট্টগ্রামে ভোলার অভিবাসী সবচেয়ে বেশি

অনলাইন ডেস্ক

২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ | ২:২৫ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপ বলছে, মহানগরী ঢাকা ও চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ সংখ্যক খানা (একই রান্নায় খাওয়া পরিবার) স্থানান্তরিত হয়েছে ভোলা জেলা থেকে। বঙ্গোপসাগরের জলবেষ্টিত দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলাটি থেকে ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনগত সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কাজের সন্ধানসহ নানা প্রয়োজনে ঢাকা ও চট্টগামে এসেছেন। দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের ৮৬টি স্থানে ২ হাজার ১৫০টি পরিবারের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছে সরকারি সংস্থাটি।

নগরাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগী নির্বাচনের উপায় নির্ধারণের লক্ষ্যে খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণের জন্য ২০১৯ সালের ৮-২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়। ‘নগর আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিরূপণ জরিপ ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি নিম্ন আয়ের মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আয়ের ভিত্তিতে জরিপটি পরিচালনা করে বিবিএস।
ঢাকা ছাড়াও বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহে এ জরিপ পরিচালিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, দেশের বড় শহরগুলোতে যে মানুষ বাস করে তার ২৮ শতাংশ পরিবার সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর। বাকি ৭২ শতাংশ বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে। তবে রাজধানী ঢাকায় এই হার ৮০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ঢাকার ৮০ ভাগ পরিবার বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে।
বিবিএস বলছে, অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের শিকার বিপুল সংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, নাগরিক সুবিধাসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে।

খানা স্থানান্তরে শীর্ষ ১০ জেলা

বিবিএসের জরিপের নবম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নগরায়ণের নাটকীয় বৃদ্ধি নগর দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। কাজ, শিক্ষা, জলবায়ুর প্রভাব থেকে রক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে লাখ লাখ মানুষ পল্লী অঞ্চল ছেড়ে শহরাঞ্চল বা শহরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে স্থানান্তরিত হন। কিছু কিছু স্থানান্তর স্বেচ্ছায় হলেও মূল উদ্বেগ হলো ঝুঁকির মুখে থাকা খানাসমূহের অনিচ্ছাকৃত স্থানান্তর ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে যোগসূত্র।

গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদন জানায়, গত ১০ বছরে রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ এসেছে বরিশাল বিভাগ থেকে। যার পরিমাণ ২১ শতাংশ। আর গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ এসেছে কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে। এরপরের জেলা হিসাবে রয়েছে বরিশাল, ময়মনসিংহ ও ভোলা। তবে বিবিএসের নতুন জরিপে দেখা যাচ্ছে, ভোলা থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ খানা ঢাকা ও চট্টগামে স্থানান্তরিত হয়েছে। এরপরই রয়েছে বরিশাল। বিবিএস তাদের খানা জরিপে যেসব পরিবার পেয়েছে তাদের মধ্যে বরিশালের রয়েছে ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ, তৃতীয় অবস্থানে থাকা সিরাজগঞ্জের ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ, চতুর্থ ঢাকার ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ, পঞ্চম কুমিল্লার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, ষষ্ঠ কিশোরগঞ্জের ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ, সপ্তম চট্টগ্রামের ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ, অষ্টম চাঁদপুরের ৩ দশমিক ১ শতাংশ, নবম ফরিদপুরের ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং দশম বাগেরহাটের ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ

এসব পরিবার রাজধানীতে স্থানান্তরিত হওয়ার কারণ হিসাবে রয়েছে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, কাজের সন্ধানে ৮৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দশমিক ৪৯ শতাংশ, জোর করে উচ্ছেদ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার প্রয়োজনে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে এসেছেন এমন খানার সংখ্যা ৩ দশমিক ০৩ শতাংশ।

দারিদ্র্যের কশাঘাত ও সামাজিক সুরক্ষায় পিছিয়ে

বিবিএসের ওই জরিপে দেখা গেছে, দেশের নগরাঞ্চলের বাসিন্দারা মাসের মোট ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করে খাদ্যের পেছনে। আর ঘর ভাড়ার জন্য তাদের ব্যয় হয় খরচের এক-পঞ্চমাংশ। জরিপ চলাকালীন এক মাসে দেখা যায়, খাবার নিয়ে চিন্তায় ছিলেন ২১ শতাংশের বেশি মানুষ। আর খাবার না পেয়ে একবেলা উপোস থাকতে হয়েছে ৭ শতাংশকে। পছন্দের খাবার খেতে পারেননি ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ।

জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাভোগী খুবই কম। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, শিক্ষার সর্বস্তরের উপবৃত্তি, পেনশন ও খোলাবাজারে ক্রয়সহ (ওএমএস) ২০ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী মাত্র ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এছাড়া বয়স্ক ভাতা ২ দশমিক ২০ শতাংশ, ওএমএস ১ দশমিক ২৭ শতাংশ ও পেনশন কর্মসূচি ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত এক বছরে বিভিন্ন কারণে ২৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ে পড়েছেন। এরমধ্যে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ বিপর্যয়ে পড়েছেন।

কী বলছেন ভোলার মানুষ?

বিবিএসের জরিপের সূত্র ধরে ঢাকার কয়েকটি বস্তি এলাকায় খোঁজ নিয়েছে দেশ রূপান্তর। তার মধ্যে একটি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বোটঘাটের বক্করের বস্তি। এতে অন্তত ১০০টি পরিবারের বাস। যাদের সবাই ভোলা থেকে এসেছেন। এখানে গত ৩৫ বছর ধরে বাস করেন নাজমা বেগম। যিনি শিশু বয়সে বাবা মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। ভোলার লালমোহন উপজেলায় একসময় তাদের বাড়ি ছিল। তবে বাড়ি ভিটে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় বাঁচার তাগিদে ঢাকায় আসতে বাধ্য হয় নাজমা বেগমের পরিবার।

রিকশাচালক রিপন পাঁচ বছর আগে স্ত্রী মাছুমা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় তার বাড়ি। তিনি সাগরে মাছ ধরতেন। তবে পারিশ্রমিকে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সপরিবারে জন্মভিটা ছাড়েন তিনি। মাছুমা বেগম বলেন, ‘জন্মভিটা কেউ ছাড়তে চায় না। কিন্তু আমগোর তো উপায় নাই। এই বস্তি ছাইড়্যা যে আর ফিরুম এই জীবনে আর হইবো না। কারণ বাড়ি ভিটা যা আছে তা দুই এক বছরের মধ্যে নদী গিইল্যা খাইবো।’ বস্তিবাসী জানান, একদিকে নদী ভাঙে অন্যদিকে চর গড়ে। তবে এসব দখল করার সামর্থ্য তাদের নেই। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব দখলে নেয়। আর বাড়িভাঙা মানুষ উপায়হীন হয়ে চলে আসেন ঢাকায়। নদী ভাঙন ছাড়াও স্থানান্তরিত হওয়ার পেছনে রয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, লবণাক্ত পানির প্রভাবে ফসলহানিসহ নানা কারণ।

নগর দরিদ্র নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের তিনটি অঞ্চলের মানুষ নগরমুখী হচ্ছে। প্রথমত, দরিদ্র অঞ্চলগুলো থেকে আসছে কাজের সন্ধানে; দ্বিতীয়ত, দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলো থেকে আসছে বাড়িঘর হারিয়ে; তৃতীয়ত, ঢাকা ও চট্টগ্রামের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে আসছে অধিক সুযোগের প্রয়োজনে। ভোলা থেকে মানুষ আসার কারণ সেখানে দুর্যোগ, দারিদ্র্য এবং সুযোগের অভাবএই তিনটাই আছে।সূত্র: দেশ রূপান্তর

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট