চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পাল্টে গেছে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের চিত্র

পাল্টে গেছে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের চিত্র

আরফাতুল মজিদ, কক্সবাজার

২৫ আগস্ট, ২০২০ | ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

আজ ২৫ আগস্ট। ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার তিন বছর পূর্ণ। সেদিন চরম অসহায়ত্ব নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা পেয়েছিল মানবিক সহায়তা। স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হওয়া সেই সহযোগিতা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে পাল্টে গেছে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের চিত্র।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন শুরু করে। ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন উখিয়া টেকনাফে। বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতায় দেশি-বিদেশি নানা সংস্থার অর্থায়নে রাখাইনের দুর্বিষহ জীবন-যন্ত্রণা অনেকটা ভুলে গেছে রোহিঙ্গারা। নিজেদের দেশের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা নিয়ে তারা আশ্রিত দেশে অবাধে বিচরণ করছে।

আশ্রিত জীবনে নিজ দেশ মিয়ানমারের চেয়ে শতগুণ বেশি স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় দেশে ফিরতে নানা তালবাহানা করছে রোহিঙ্গারা। তারা আগে মিয়ানমারে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা না পেলেও এখন জীবন ধারণের নানা অনুষঙ্গ দিতে রাজি হয়েছে দেশটি। তারপরও নিজ দেশে ফিরতে চাচ্ছে না রোহিঙ্গারা। নাগরিকত্বসহ নানা দাবির দোহাই দিয়ে তারা পরপর দুইবার প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত ভেস্তে দিয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৭ এর ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে আট লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে মিয়ানমারের ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস এখন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। সীমান্তবর্তী এই দুই উপজেলার ২৮টি পাহাড়ের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের দুই লাখেরও বেশি ঝুঁপড়িতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। এর প্রভাব পড়েছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারেই। ওই অঞ্চলের উন্নয়ন হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপত্তা ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে দুই উপজেলার বাসিন্দারা।
রোহিঙ্গার সেই ঢল যে এত বড় ও দীর্ঘমেয়াদী হবে সেটা ভাবতে পারেনি স্থানীয় বাসিন্দারা। সেদিন যারা মানবিকতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল আজ তারাই বড় দুর্দশা ও ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে। অনেকের ফসলি জমি, বাড়ির উঠান পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে। কবে নাগাদ রোহিঙ্গারা ফিরবে বা আদৌ তারা ফিরবে কি না, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা। রোহিঙ্গাদের প্রথম আশ্রয় দেয়া স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত তিন বছর আগে আসা অসহায় রোহিঙ্গা নেই তারা। আচার-আচরণ পাল্টে তারা ক্রমে উগ্র হয়ে উঠছে। কথায় কথায় স্থানীয়দের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে জড়াচ্ছে, বুক কাঁপছে না খুন করতেও। তাদের বীরদর্পে ঘুরে বেড়ানো দেখলে আশ্রিত বলে মনেই হয় না।

২৫ আগস্টের বিষয়ে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়ার দিন। এই দিন তাদের কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনকে সামনে রেখে কক্সবাজার ক্যাম্প এলাকায় বিভিন্ন এনজিও সংস্থা সভা করার অনুমতি চেয়েছে সরকারের কাছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের এই মহামারিতে সবধরণের আয়োজন ও সভা বন্ধ রাখা হয়েছে। কোনো কিছু করার অনুমতি দেয়া হয়নি। তারপরও এই ব্যাপারে স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। কুটনৈতিক পর্যায়ে এখন প্রত্যাবাসনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তাদের জোর করে ফেরাতে চাচ্ছি না বলেই প্রত্যাবাসনে দেয়া দুই বারের সময় ভেস্তে গেছে। এরপরও রোহিঙ্গাদের কাছে মিয়ানমারের দেয়া ঘোষণা তুলে ধরে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় চালিয়ে যাচ্ছি। হয়তো একদিন রোহিঙ্গারা বিষয়টি বুঝে স্বেচ্ছায় চলে যাবে।

মিয়ানমারের সরকার দাবি করে, রাখাইন রাজ্যে দেড়শোর মতো মুসলিম জঙ্গি এক যোগে বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, সীমান্ত ফাঁড়ি এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির অফিস থেকে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্য রয়েছে। এর পর থেকেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। শুরু হয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্রোতের মত রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে প্রবেশ। নাফ নদী পার হয়ে ছোট ছোট নৌকায় তারা আসতে থাকেন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায়। নারী, পুরুষ, শিশু দিনের পর দিন পায়ে হেটে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আসতে থাকে। সবার মুখে নির্যাতনের ভয়াবহ গল্প।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে মিয়ানমার থেকে আসা আলমাস খাতুন বলছিলেন, “আমার স্বামী এবং একমাত্র ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গেছে। আমি জানি না আদৌ তারা বেচে আছে না মারা গেছে”।

গতকাল সোমবার (২৪ আগস্ট) উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, তিন বছর আগের চেহারা পাল্টে গেছে রোহিঙ্গাদের। ফুরফুরে চলাফেরা তাদের। নেই কোনো ভয়, নেই কোনো উৎকণ্ঠা। খেলায় মেতে উঠছে শিশুরা। নিজ দেশের মতো জীবনযাপন তাদের।

কুতুপালং তিন নম্বর ক্যাম্পের মাবিয়া খাতুন (৬৫) বলেন, কয়েক প্রজন্ম পার করেছি রাখাইনে। কিন্তু ২০১৭ সালের মতো ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়নি। যে স্মৃতি নিয়ে এসেছি, বাকি সময়টা এই ঝুপড়ি ঘরে (বাংলাদেশে) কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নাগরিকত্ব ও নিরাপদ পরিবেশ পেলে ফিরেও যেতে চাই। কারণ স্বামী ও স্বজনদের কবরের পাশে শেষ যাত্রাটা পাব।

কুতুপালং ক্যাম্পের এ-২ ব্লকের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বলতে গেলে মিয়ানমারের চেয়ে আমরা এখানে ভালো আছি। সামরিকজান্তাদের (মিয়ানমারের) কথায় বিশ্বাস নেই। আন্তর্জাতিক মহলের চাপে পড়ে তারা আমাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বললেও সেখানে নিয়ে ভিন্ন আচরণ করবে। নাগরিকত্ব না দিয়ে উল্টো ক্যাম্পেই বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য করাবে তারা।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, মানবিক আশ্রয়কে রোহিঙ্গারা অপব্যবহার করছে। সরকারের সামগ্রিক সহযোগিতা পেয়েও নানা অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য ‘বিষফোড়া’ হয়ে উঠছে। তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

এদিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আত্তীকরণের কোন ধরনের চিন্তাকে নাকচ করে দিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, এ ধরনের কোনও চিন্তা সরকারের নেই। গতকাল সোমবার (২৪ আগস্ট) নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: পশ্চিমা বিশ, এশিয়ান ও দ্বিপক্ষীয় পটভূমি’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তিনি একথা বলেন। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসার ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

পররাষ্ট্র সচিব জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ধরনের কোন বিনিয়োগও বাংলাদেশ চায় না। কারণ এর ফলে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা একটি জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিকীকরণের জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবে অভিহিত করে সচিব বলেন, এর সমাধান মিয়ানমারেই আছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রীতিনীতি ভঙ্গ করে রোহিঙ্গাদের অত্যাচার চালানো হয়েছে এবং সেই কারণে দায়বদ্ধতার বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে জানিয়ে মাসুদ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ কোর্ট ও আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলছে।

বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সচিব বলেন, আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সবসময়ে সব বিষয়ে যোগাযোগ রেখেছি কিন্তু স্পষ্টভাবে বলতে গেলে প্রতিবেশী দেশ আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মর্যাদা দেয়নি। দুইবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এর কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে ভয় পাচ্ছে।

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পরে রোহিঙ্গারা যেন জীবন জীবিকা অর্জন করতে পারে তার জন্য গ্রেড ৬ থেকে ৯ পর্যন্ত মিয়ানমার কারিকুলামে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। ভাষানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে বলেন, আমরা সেখানে রোহিঙ্গাদের সরেজমিনে নিয়ে যাব। সেখানকার অবস্থা ভালো মনে করলে বর্ষা মৌসুমের পরে তাদের সেখানে স্থানান্তর করা হবে।

 

 

 

 

 

 

পূর্বকোণ/আরাফাত-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট