চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

চমেক হাসপাতালের কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ড এটি। অপ্রতুল ব্যবস্থার মধ্যেও করোনা রোগীর উপচে পড়া ভিড় ওয়ার্ডের বারান্দায় পর্যন্ত। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তোলা ছবি।-পূর্বকোণ

শ্বাস নিতে চায় চট্টগ্রাম

আহমেদ শরীফ শুভ

৩ জুন, ২০২০ | ২:২১ পূর্বাহ্ণ

ঢাকার মতো চট্টগ্রামও কোভিডের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামে পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে বেডের অভাবে অনেক রোগী ভর্তি হতে পারছেন না। যারা ভর্তি আছেন তাদের নিবিড় সেবা দিতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যার মোকাবেলা করতে না পারলে খুব দ্রুত পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটবে। নীতিনির্ধারক ও স্বাস্থ্যপ্রশাসনকে বাস্তবতার নিরিখে অগ্রাধিকার ঠিক কওে দ্রুত কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একথা সর্বজন বিদিত যে পায় ৮০% কোভিড রোগী উপসর্গবিহীন বা মৃদু উপসর্গধারী হন। তাদের অধিকাংশের কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, কিংবা তারা বাসায় থেকে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে রোগের সংক্রমণ কমাতে তাদের নিজ বাসায় স্বতন্ত্র কক্ষে আইসোলেশনে থাকতে হয়। বাকি ২০% রোগীর উপসর্গ মাঝারি থেকে গুরুতর হওয়ায় তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। তাদের মধ্যে ৫% কে আইসিইউ বা এইচডিইউতে নিবিড় পরিচর্যায় থাকতে হয়, কারো কারো কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাস চালানোর জন্য ভেন্টিলেটারের প্রয়োজন হয়। বাকি ১৫% সাধারণ ওয়ার্ডে অক্সিজেনসহ অন্যান্য সহায়ক (সাপোর্টিভ) চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেন। চট্টগ্রামসহ হটস্পটগুলোতে যে গতিতে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে তাতে এই ১৫% এর সংখ্যা সহসাই হাজার হাজারে পৌঁছে যাবে। পাশ্চাত্যের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশগুলোতেও ভেন্টিলেটারে থাকা রোগীদের ৫০% এর বেশি বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশে একে তো ভেন্টিলেটারের অপ্রতুলতা তদুপরি ব্যাপক সংখ্যক ভেন্টিলেটর পরিচালনা করার পর্যাপ্ত দন্ত চিকিৎসকের অভাবে এই অবস্থার আশু উন্নতির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যেহেতু প্রায় ৮০% রোগী আমাদের বাড়তি মনোযোগ ছাড়াই ভালো হয়ে উঠছেন এবং প্রায় ৫% কে উন্নত সেবা দেয়া এই মূহুর্তে কঠিন, তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের মাঝারি সেবার প্রয়োজন হওয়া ১৫% এর দিকে আশু মনোযোগী হওয়া উচিত। যদি তা না করা যায় তবে তাদের অবস্থার অবনতি হয়ে গুরুতর অসুস্থদের দলে চলে যাবে এবং নিবিড় সেবা প্রয়োজনকারীদের দল ভারি করে চূড়ান্ত বিপর্যয় ডেকে আনবে। পক্ষান্তরে, তাদের সুস্থ করে তুলতে পারলে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের দিকে আরো মনোযোগ দেয়া যাবে, সেই দলের মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
এই ১৫% রোগীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অক্সিজেন। তাদের কারো কারো প্রয়োজন হবে উচ্চ প্রবাহমান (হাই-ফ্লো) অক্সিজেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার ও নাকে নল লাগানোর মাধ্যমে তাদের এই অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। সেই সাথে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপের জন্য প্রয়োজন হয় আঙুলের মাথায় লাগানো পালস-অক্সিমিটার, যা একটি সহজলভ্য মেশিন। যাদের হাই-ফ্লো অক্সিজেন প্রয়োজন তাদের জন্য হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা প্রয়োজন হবে। সেই সাথে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর নামের আরেকটি মেশিনও এই পরিস্থিতিতে খুবই সহায়ক হতে পারে। এই মেশিনের মাধ্যমে কক্ষের বাতাসে থেকে অক্সিজেন আহরণ করা যাবে, মজুদ অক্সিজেন থেকে সরবরাহ করতে হবে না। ফলে মজুদকৃত অক্সিজেনের ঘাটতি কমে আসবে। এসব মেশিনগুলো সবার সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সংগ্রহ করা খুব কঠিন কোন কাজ নয় এবং এগুলো খুব বেশি ব্যয়বহুলও নয়। তবে এসব রোগীদের অক্সিজেন-চিকিৎসা দেয়ার জন্য বিদ্যমান হাসপাতালগুলোর বেডের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। কারণ, তারা ইতিমধ্যেই ধারণক্ষমতা অতিক্রম করে গেছে।
যে ১৫% রোগীর কথা এখানে বলা হয়ছে তার সংখ্যা কয়েকদিনের মধ্যেই জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। তাদের সমবেত শ্বাসকষ্ট হয়ে দাঁড়াবে চট্টগ্রামসহ সবগুলো হটস্পটের দম আটকে আসার প্রতিচ্ছবি। এসব রোগীর অবস্থার অবনতি ও মৃত্যুঝুঁকি কমাতে প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক অক্সিজেন সরবরাহের দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করা। সেই সাথে সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য তাদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন। অথচ বিভাগীয় শহরের এবং উপজেলার হাসপাতালগুলো মিলিয়ে আইসোলেশন বেডের যে সংখ্যা তাতে সংক্রমিতদের কিয়দংশেরও স্থান সংকুলান কিংবা চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। অথচ উন্নত প্রযুক্তি বা বিশাল বাজেটনির্ভর না হয়েও এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব।
জরুরিভিত্তিতে বেশ কিছু ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন মহল থেকে এই ফিল্ড হাসপাতালের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেশ কিছুদিন ধরেই উচ্চারিত হয়ে আসছে। ফিল্ড হাসপাতালের জন্য আহামরি কোন ভৌত প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। বন্ধ হয়ে থাকা কমিউনিটি সেন্টার ও স্কুল কলেজগুলোকে সহজেই অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতালে রূপান্তর করা সম্ভব। হাসপাতাল-উপযোগী বেডের অবর্তমানে প্রয়োজনে মেঝে বেড পেতেও রোগীদের সেবা দেয়া সম্ভব। সেই ফিল্ড হাসপাতালগুলোতে কেবলমাত্র অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করে বহু প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। এর জন্য ভৌত অবকাঠামোগত কোন আশু পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না। এই রোগীদের কিছু উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসারও দরকার হবে, সেই সাথে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করতে অনেককে দিতে হবে রক্তের ঘনত্ব কমানোর ওষুধ। এর সবই ফিল্ড হাসপাতালে ব্যবস্থা করা সম্ভব। রোগীদের উল্লিখিত সেবাগুলো নিশ্চিত করতে হাতে থাকা চিকিৎসক ও নার্সদের পাশাপাশি প্রয়োজনে মেডিকেল এসিস্ট্যান্টদের (সাব এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার) কাজে লাগানো যেতে পারে। স্বল্প মেয়াদি এমনকি এক/দুই দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েও বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে এই অক্সিজেন ও রক্তের ঘনত্ব কমানোর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞ ও মাঝারি পর্যায়ের চিকিৎসকেরা দূর থেকে অডিও বা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সামগ্রিক তত্ত্বাবধান করতে পারবেন।
যাদের আরো বেশি নিবিড় চিকিৎসা দিতে হবে তাদের অবশ্যই স্থায়ী হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু সেখানে বেডের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। তদুপরি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া কোন সরকারী হাসপাতালেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন নেই, সিলিন্ডারের উপর ভরসা করতে হচ্ছে। অথচ গুরুতর অসুস্থ রোগিদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের প্রয়োজন। এমনকি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটেও সব রোগীকেও সেন্ট্রাল লাইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। স্থায়ী হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল লাইনের ব্যবস্থা করা খুব ব্যয় কিংবা সময়সাপেক্ষ ব্যাপারও নয়। প্রয়োজন ত্বরিৎ উদ্যোগ। আরেকটি কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য যে আইসিইগুলোতে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর ও প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি মেটাতে সি-প্যাপ (কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার) মেশিনের মাধ্যমেও উচ্চচাপে রোগী ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব। শিখিয়ে দিলে রোগীর অবস্থা শোচনীয় না হলে তিনি নিজেও এটির ব্যবহার রপ্ত করতে পারেন।
আমাদের এখন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যা করা প্রয়োজন :
জরুরিভিত্তিতে বেশ কিছু ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, ২) প্রচুর অক্সিজেন সিলিন্ডার, পালস-অক্সিমিটার, হাই-ফ্লো ন্যাজল ক্যানুলা, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ও সি-প্যাপ মেশিনের ব্যবস্থা করা, ৩) সবধরনের স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বল্প-মেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে (প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে) অক্সিজেন-চিকিৎসা দিতে সক্ষম করে তোলা এবং ৪) স্থায়ী হাসপাতালগুলোতে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের ব্যবস্থা করা।
এই পদক্ষেপগুলো মোটেও সময়সাপেক্ষ নয়। তবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল না হলেও বেশ অর্থেও প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার উদ্যোগের সমন্বয় করতে হবে। চট্টগ্রামে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতির অভাব নেই। সারা শহর এবং জেলার যখন দম আটকে আছে সে পরিস্থিতিতে তারা এই সমবেত চেষ্টায় শ্বাসকষ্ট নিরসন করে হাজার হাজার প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন – সবাই সেটাই প্রত্যাশা করে। চট্টগ্রাম যদি এই ব্যবস্থাপনার অগ্রপথিক হয় সারা দেশ, বিশেষ করে ঢাকাসহ কোভিডের হটস্পটগুলো এই পদাংক অনুসরণ করতে পারবে।
চট্টগ্রাম বহু বিষয়ে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আবারো এই সময় উপস্থিত। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতিরা এগিয়ে এলে এই ভয়াল পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে। উদ্যোগ নিতে হবে আজই।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ও অনাবাসিক শিক্ষক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ফ্যামিলি মেডিসিন এন্ড রিসার্চ, ইউএসটিসি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট