চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি এখনো, দূষণ বাড়ছে আরও

অনলাইন ডেস্ক

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৭:৩১ অপরাহ্ণ

মাতৃভাষার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া একমাত্র জাতি বাঙালি। ৬৮ বছর আগে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) বাংলা ভাষা দাবির আন্দোলনে গুলিতে প্রাণ দেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বাররা। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের বয়সও ৪৯ হয়েছে। কিন্তু এখনো সর্বস্তরে বাংলার জন্য হাপিত্যেশ করতে হচ্ছে। এমনকি ভাষাসংগ্রামীদের আত্মাহুতির ৮ ফাল্গুনও চরম অবহেলিত। যাচ্ছেতাইভাবে বাংলাকে বিকৃত করে দূষণের পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে ইংরেজির দাপট ও প্রচলনে প্রজন্ম মাতৃভাষার অধিকার হারাতে বসেছে।

ভাষাসংগ্রামী, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, আদালত, প্রচার-সম্প্রচারমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার অবহেলিত রয়ে গেছে। এখন ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণে অদ্ভুত ভাষা তৈরি করা হয়েছে। বাংলার করুণ অবস্থার জন্য শিক্ষিত, অভিজাত শ্রেণি ও অভিভাবকদের উদাসীনতা, সদিচ্ছার সঙ্গে হীনম্মন্যতাকে দায়ী করছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের আগেই ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে সর্বস্তরে বাংলা চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য দেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে সচেষ্ট হন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের প্রথম ভাগের ৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই প্রচেষ্টা পরবর্তী সময়ে অব্যাহত থাকেনি। ফলে দীর্ঘদিন অপব্যবহারে বাংলা বিকৃত ও দূষিত হয়ে গেছে। ভাষাসংগ্রামী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এখনো এ দেশে অনেকের মস্তিষ্কে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভাবধারা রয়েছে। তারা ইংরেজির মাধ্যমে নিজেদের জাহির করতে চান।

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক মনে করেন, বৈষম্য থেকে বাঙালির মুক্তি পাওয়ার দাবিদাওয়া ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সামরিক-বেসমারিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পসহ সব ক্ষেত্রে বৈষম্য ঘুচে প্রতিষ্ঠা পায় শিক্ষিত ও অভিজাত শাসকগোষ্ঠী। এরা জাতিকে মূল চেতনায় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেন। ফলে অন্যান্য বিষয়ের মতো মাতৃভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষার দৈন্যদশার জন্য তথাকথিত শিক্ষিত, অভিজাত শ্রেণির দায় বেশি। তাদের মধ্যে বাংলা নিয়ে চরম অনীহা রয়েছে। ফলে তাদের সন্তানরাও বাংলার বিষয়ে উদাসীন। জাতিরাষ্ট্রের প্রাথমিক শর্ত মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষা—এ বোধোদয় না হলে প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন হবে না।’

উপেক্ষিত আইন : ১৯৮৭ সালের ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’র ৩ (১) ধারা অনুযায়ী, দেশের সব সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্র্তৃক বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য কার্যাবলির নথিপত্র অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। আইন অনুযায়ী কর্মস্থলে কেউ বাংলার পরিবর্তে অন্য ভাষা ব্যবহার করলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এ আইন লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বাস্তবতা হলো, কোথাও এ আইন প্রতিপালিত হচ্ছে না এবং এ জন্য জবাবদিহির নজিরও নেই। বাংলা ভাষা ব্যবহারের আকাল রয়েছে আদালত অঙ্গনেও। উচ্চ আদালতের খুব নগণ্য সংখ্যক বিচারক বাংলায় রায় ও আদেশ দেন। স্বল্পসংখ্যক আইনজীবী মামলার নথি তৈরি ও সওয়াল-জওয়াব বাংলায় করেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে একুশে ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি ৮ ফাল্গুন তারিখ ব্যবহারের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, বিদেশি দূতাবাস ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে সব স্থানে সাইনবোর্ড, নামফলক, বিজ্ঞাপনী বোর্ড ও টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপন বাংলায় হতে হবে। আদেশের পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের প্রয়োগ নিয়ে রুল জারি করেছিল আদালত। তবে উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন আজও হয়নি।

এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, ‘নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আদালত অবমাননার অভিযোগও এনেছিলাম। পরে সরকারের সংশ্লিষ্টরা আদালতকে জানান, তারা কিছু ক্ষেত্রে বাংলা বাস্তবায়ন করেছেন। আর সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। পরে এ নিয়ে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দুঃখজনক হলো উচ্চ আদালতের বেশির ভাগ বিচারক ও আইনজীবী কর্মক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার করেন না।’

এ ছাড়া ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষায় এক নির্দেশনায় বলে, টেলিভিশন ও বেতারে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও এই ভাষাকে যাতে ব্যঙ্গ করা না হয়। পাশাপাশি বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও ব্যঙ্গ করা রোধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি কমিটির আদেশ দেয়। ২০১৩ সালে কমিটি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে বেশ কিছু সুপারিশ করে। কিন্তু এই সুপারিশ আর আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি বিষয়টি নিয়ে শুনানির উদ্যোগও হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন দাখিল ও সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু পরে আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষার বিকৃতি, দূষণরোধ ও সর্বস্তরে বাংলার জন্য সরকারি থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং সেটিকে বাস্তবায়ন করতে হবে।’

কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে আমরা ইংরেজির দ্বারস্থ হচ্ছি। ফলে অজান্তেই মাতৃভাষার অধিকার হারিয়ে ফেলছি। আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। আবার আমরাই একমাত্র দেশ, যেখানে বিকৃত করতে করতে মাতৃভাষাকে শেষ করে ফেলছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাষার শৃঙ্খলা না থাকলে সড়কে বিশৃঙ্খলা থাকবে এটিই স্বাভাবিক। ভয়টা হচ্ছে এ বিশৃঙ্খলার চর্চা বেড়ে গেলে সব উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। এ জন্য মাতৃভাষা সুরক্ষায় আমাদের প্রতিটি পরিবারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’

তথ্যসূত্রে দেশরুপান্তর

পূর্বকোণ/-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট