চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইন্দ্রপুরীর সঙ্গীত-সন্ধানী

শিল্পী ইন্দ্রাণী পাঠক

নাদো প্রতিবেদন

১৮ মে, ২০১৯ | ২:১১ পূর্বাহ্ণ

“এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়
জগতপুরবাসী কবে কোথায় ধায়।।
কোন্ অমৃতধনের পেয়েছে সন্ধান
কোন্ ক্ষুধা করে পান।”
কবিগুরুর এই গানটির মতোই শিল্পী ইন্দ্রাণী পাঠকের সঙ্গীত জীবন। সঙ্গীত ছাড়া অচল মানব-জীবন। সুর ছড়িয়ে আছে সবখানে। সুর প্রেম-বিরহ আর আনন্দ-বেদনার এক অনুপম কাব্য। ইন্দ্রাণী সেই সুরের সাধনা করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন। ঈশ^র প্রদত্ত কণ্ঠের সঙ্গে অসাধারণ গায়কী সবকিছুই আছে-কিন্তু প্রচার বিমুখ। খ্যাতির মোহে অমৃতের সন্ধানে ছুটতে নারাজ।
পারিবারিক সঙ্গীত পরিবেশেই বেড়ে উঠেছেন ইন্দ্রাণী। বাবা অসীম কুমার পাঠক তৎকালীন পাকিস্তান রেডিওর শিল্পী ছিলেন। ঠাকুরমা ইন্দুলেখা পাঠকও সঙ্গীতচর্চা করতেন। ফলে, বাবার কাছেই গানে হাতেখড়ি। পরবর্তীকালে ওস্তাদ মিহির লালার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এবং জয়ন্তী লালার কাছে নজরুল সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন। এছাড়া সুরবন্ধু অশোক চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, বাণী কুমার চৌধুরী, মৃণাল ভট্টাচার্য, পঙ্কজ সূত্রধর প্রদীপ দাশ, মোস্তফা কামালের কাছে গান শিখেছেন। আর্যসঙ্গীত সমিতি, সুরেন্দ্র সঙ্গীত বিদ্যাপীঠেও তালিম নিয়েছেন। মা আলপনা পাঠকের অনুপ্রেরণা তার পাথেয় হয়েছে। ছোট ভাই অভিজিৎ পাঠক তার এগিয়ে চলার নির্দেশক।
ইন্দ্রাণী চট্টগ্রাম নজরুল শিল্পী সংস্থার একজন সদস্য। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও শিক্ষক শীলা মোমেনের কাছে রবীন্দ্র সংগীতে তালিম নিয়েছেন। তার দক্ষতার পিছনে কবি, সাংবাদিক আবুল মোমেনের কাছে ঋণী। শুধু গান নয়, আবৃত্তি, নাচ, উপস্থাপনা এ বিষয়গুলোতেও ইন্দ্রাণী যথেষ্ট পারদর্শী। নার্সারিতে পড়াকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ নাটকে ছোট্ট মিনির চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। ২০১৭ সালে তার নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় সেন্ট প্ল্যাসিড্স স্কুল এ- কলেজে উপস্থাপিত হয় গীতিনাট্য ‘ষড়ঋতুর মানভঞ্জন’।
সঙ্গীতের পাশাপাশি পড়াশোনায়ও কৃতী ছাত্রী ছিলেন ইন্দ্রাণী পাঠক। পোর্ট অথরিটি গার্লস স্কুল, সরকারি মহিলা কলেজ হয়ে সরকারী সিটি বিশ^বিদ্যালয় কলেজ থেকে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে বিএসএস (অনার্স) ও এমএসএস ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী সেন্ট প্ল্যাসিড্স স্কুল এ- কলেজের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত। তাছাড়া তিনি মাস্টার্স ট্রেনার হিসেবে বাংলাদেশ এ- গ্লোবাল স্টাডিজ-এ কাজ করছেন। উল্লেখ্য, ইন্দ্রাণী প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি বছর প্রথম হতেন। স্কুলে সদাচারণের জন্য প্রথম হয়ে ‘দেবদাস’ বইটি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন।
মূলত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হলেও ইন্দ্রাণী আধুনিক ও পঞ্চকবির গানে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি মনে করেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম থাকলে একজন শিল্পী যে কোন ধরনের গান করতে পারেন। ইন্দ্রাণী বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের ‘এ’ গ্রেড’র শিল্পী।
শিল্পী ইন্দ্রাণী পাঠকের একক সঙ্গীত সন্ধ্যা “খুঁজি তারে আমি আপনায়” ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র বাংলাদেশ তার এই একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সঙ্গীত জীবনে ইন্দ্রাণী অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত নজরুল সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় তিনি তৃতীয় স্থান লাভ করেন। একই প্রতিযোগিতায় তিনি ১৯৯৪ সালে আধুনিক গানে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
শিল্পী ইন্দ্রাণী পাঠকের বহু গান বর্তমানে ইউটিউবে প্রচারিত হয়। তার মধ্যে ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার’, ‘আমার চোখের জলের মাঝে’, ‘দুটি মন আজ নেই দুজনার’, ‘আয় খুকু আয়…আয় খুকু আয়’, ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালে বৈশাখী টেলিভিশনে তার একক সঙ্গীত প্রচারিত হয়।
শিক্ষকতা ও সঙ্গীত কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেন এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, শিক্ষকতা তার পেশা এটির গুরুত্ব আলাদা। তবে সঙ্গীত তার প্রাণ। প্রাণের টানেই সঙ্গীতচর্চা করে যাচ্ছেন। নিজের সঙ্গীত জীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ইন্দ্রাণী বলেন, ২০১৯ সালে স্বরলিপি আয়োজিত মাতৃভাষা গান প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে দেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে গ্রুমিং করার সুযোগ পাওয়া। এই গ্রুমিং তার খুব কাজ দিয়েছে। ইন্দ্রাণী মনে করেন, সব শিল্পীকে এই গ্রুমিং-এর মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত।
শিল্পী ইন্দ্রাণী পাঠক সঙ্গীতের মানুষ হলেও সাহিত্যের প্রতি তার রয়েছে গভীর ঝোঁক। কবিতা, ছোটগল্প ছাড়াও উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন অনেক। এসব দৈনিক আজাদীসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা মূলত শিক্ষা বিষয়ক হলেও প্রেমের কবিতা ও ছোট আঙ্গিকের উপন্যাসে তার সাহিত্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ, সমরেশ, সুনীল, বুদ্ধদেব গুহ ও হুমায়ুন আহমেদ তার পছন্দের সাহিত্যিক। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা নিয়ে পড়াশোনা করছেন।
ব্যক্তি জীবনে শ্যামল চৌধুরীকে জীবন-সঙ্গী করেছেন। তাদের দুই কন্যা ঐন্দ্রিলা ও অরিত্রিকে নিয়ে সুখের সংসার। স্বামী তার সঙ্গীতসহ লেখালেখির অনুপ্রেরণাদাতা। এ বিষয়ে তাকে সব ধরনের সহযোগিতার পাশাপাশি স্বাধীনতাও দিয়েছেন।
সঙ্গীতচর্চার মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের অন্তরে জায়গা করে নিতে চান। এজন্য গভীর অভিনিবেশ সহকারে সঙ্গীতচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। ইন্দ্র হচ্ছেন, স্বর্গের দেবরাজ ও সুরপতি। ইন্দ্রাণী সুরের পূজারি হয়ে থাকতে চান ইন্দ্রপত্নীর মতো। তার একটি ছোট্ট অনুভূতির কথা দিয়ে এই লেখা শেষ করতে হয়।
“কিছু শব্দ কিছু কথা তোমায় দিলাম।
আমার ছিলে কখন আমিই আমার হলাম।”

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট