চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

নিষ্পেষিত নারীর চিত্র খেলাঘর নাটকে

সনেট দেব

২৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

হেনরিক যোহান ইবসেন ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর নরওয়ের একজন প্রথাবিরোধী নাট্যকার। সমাজের নানা অসঙ্গতি, বঞ্চনা, পুরুষশাসিত সমাজে নিষ্পেষিত নারীদের তীব্র সংগ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে তার বিভিন্ন নাটকে। তাঁর একটি অনবদ্ধ, কালজয়ী অমর সৃষ্টি হলো নাটক ‘অ্যা ডলস হাউস’, যা অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায়, শতাব্দী ধরে মঞ্চস্থ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে। নারীর আত্মনির্ভরতা এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার গল্প রয়েছে এই নাটকে। ইবসেন এর বিশ্বখ্যাত এই নাটকটি অবলম্বনে চট্টগ্রামের নবগঠিত নাট্যদল ‘কথা সুন্দর’ এর প্রথম প্রযোজনা ‘খেলাঘর’। নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয় গত ১৬ অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় নগরীর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তরে ও নাটকটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয় তার পরদিন ১৭অক্টোবর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম মিলনয়াতনে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. কুন্তুল বড়–য়ার পা-ুলিপি সম্পাদনা ও নির্দেশনায় নাটকটিতে আলোক নির্দেশনা দিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাট্যমঞ্চের আলোক পরিকল্পক ও নির্দেশক সুদীপ্ত সান্যাল এবং আবহ পরিকল্পনা করেছেন দেবাশীষ রায়। নাটকটিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক পরিবারকে কেন্দ্র করে নাটকটি আবর্তিত হয়। মূলত নারী অধিকার ও নারী ব্যক্তিত্বের উন্মেষ তার নাটকের প্রধান উপজীব্য বিষয়।

নাটকের কাহিনী ধারায় দেখা যায়, বিকাশ চ্যাটার্জি ও সীমা চ্যাটার্জি সুখী দম্পতি। তাদের মধ্যে বেশ বোঝাপড়া থাকলেও একটি বিষয় সীমা দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর কাছে গোপন রেখেছে। এজন্য তার মধ্যে রয়েছে অব্যক্ত কষ্ট। একটি ব্যাংকের চেয়্যারম্যান হিসেবে বিকাশ চ্যাটার্জির সততা ও মর্যাদা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি তার অধঃস্তন কর্মকর্তা ব্যাংকের লিগ্যাল এডভাইজার কমল সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্নীতিবাজ কমল সরকার সীমা চ্যাটার্জির এক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে। বহুদিন আগে বিকাশ চ্যাটার্জি গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তার চিকিৎসার জন্য সীমা মোটা অঙ্কের টাকা ধার করেছিল কমল সরকারের কাছ থেকে। এ সময় টাকা ধার দেওয়ার জিম্মাদার হিসেবে একটি কাগজে স্বাক্ষর দেন সীমার বাবা। কিন্তু অসুস্থ বাবাকে বিব্রত না করে সীমা চ্যাটার্জি নিজেই তার বাবার স্বাক্ষরটি জাল করে দলিলে সই দিয়েছিলেন। স্বামীর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এ ছাড়া তার সামনে অন্য কোনো উপায় ছিল না। টাকা ধার করায় বিষয়টি গোপন করে সীমা স্বামীকে জানায়, এ টাকা সে তার বাবার কাছ থেকে এনেছে। প্রতি মাসে সংসারের খরচ বাঁচিয়ে সীমা দফায় দফায় কমল সরকারের কাছ থেকে ধার করা টাকা সুদসহ পরিশোধ করে ফেলেছিল প্রায়।

এ সময়ই কমল সরকার সীমাকে হুমকি দিয়ে যায়, তার স্বামী বিকাশ চ্যাটার্জি যদি তাকে বরখাস্ত করে তবে সেই সে সই জাল করা সহ ধার করার বিষয়টি ফাঁস করে দেবে। বিপাকে পরে সীমা তার স্বামীকে কমল সরকারকে বরখাস্ত না করার অনুরোধ জনায়। কিন্তু স্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বিকাশ। এ অবস্থায় সীমার টাকা ধার করা ও স্বাক্ষর জাল করার ঘটনাটি উল্লেখ করে লেটারবক্সে একটি চিঠি দিয়ে যায় কমল সরকার। এদিকে সীমার দুরসম্পর্কের বোন রঞ্জনা কমলকে দেখেই চিনতে পারে। এক সময় তারা ভালোবেসে একে অন্যকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু পারিবারিক কারণে দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় এবং এক পর্যায়ে তারা একে অন্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সীমার দুরবস্থায় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে রঞ্জনা। সে বিষয়টি রফা করার জন্য কমল সরকারের বাসায় উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বেলাশেষে বাড়ি ফিরে বিকাশ চ্যাটার্জি লেটারবক্স থেকে কমল সরকারের চিঠিটা বের করে আনে এবং পড়ে। সবকিছু জেনে বিকাশ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং সীমাকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করতে থাকে। সীমা বারবার বিকাশকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে, স্বামীর প্রাণ বাঁচাতেই সে এই কাজটি করেছে। কিন্তু বিকাশ তা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। সে সীমার আত্ম-সম্মানে আঘাত করে বিশ্রি আচরণ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে কমল মজুমদারের সঙ্গে আপস মীমাংসার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সঙ্গে স্ত্রী সীমাকে বিকাশ জানিয়ে দেয়, তারা দুজন একই ছাদের নিচে থাকলেও দুজনের স্বামী-স্ত্রী’র স্বাভাবিক সম্পর্কটি সে বজায় রাখতে চায় না।

এদিকে রঞ্জনার মধ্যস্থতায় কমল সরকার জাল সইয়ের সব কাগজপত্র ফিরিয়ে দেয়। সেগুলো হাতে পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে বিকাশ চ্যাটার্জি। সে সীমাকে জানায়, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তারা আবার আগের মতো স্বাভাবিকভাবে সংসার যাপন করবে। কিন্তু ততোক্ষণে বোধোদয় হয় সীমা চ্যাটার্জির। সে বুঝতে পারে সংসারে তার অবস্থান পুতুলের মতোই। স্বামীর মনের আসল রূপ সীমার সামনে প্রকাশিত হয়, সেখানে মানুষ হিসেবে তার কোনোই মূল্য নেই। বিকাশ চ্যাটার্জির সংসার ছেড়ে সীমা বেরিয়ে পড়ে নিজের আত্মসত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য অজানা অনির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে। স্বামীর উচ্চকিত পিছুডাক তাকে ফেরাতে পারে না।

‘যে নীড়ে পৃথিবী এসে মিশে’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম নাট্যশিল্প জগৎতে প্রথমবারের আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘কথা সুন্দর’ নাট্যদলের। ‘কথা সুন্দর’ এর প্রথম প্রযোজনায় ‘খেলাঘর’ নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইউনুস রানা, নোভা চক্রবর্তী, হিমাদ্রি শেখর রায়, সানজিদা আমিন, আহাদনুর ফকির, শাশ্বত শুভ। প্রযোজনা অধিকর্তা মামুনুল হক। সার্বিক তত্ত্বাবধানে সুবীর মহাজন। নাটকটি মঞ্চায়নে সহযোগিতায় ছিলেন, চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট