চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড সিনেমা ধর্ম বনাম বিজ্ঞান দ্বন্দ্বের রূপালি দলিল

গণশত্রু

সুজন সেনগুপ্তা

১৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:০৬ পূর্বাহ্ণ

নরওয়েজিয়ান সাহিত্যিক হেনরিক ইবসেনের নাটককে সিনেমার ছাঁচে ঢালা প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এমনটাই বলেছেন কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। ধর্ম আর বিজ্ঞানের চিরাচরিত দ্বন্দ্ব সমাজকে কী করে অস্থিতিশীল করে তোলে, সমাজের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে তার বিচারবুদ্ধি থেকে কীভাবে দূরে ঠেলে দিতে পারে, সে উপাখ্যানই বর্ণিত হয়েছে সত্যজিতের শেষ জীবনের সিনেমাগুলোর একটি, গণশত্রুতে। গণশত্রু আমাদের উপমহাদেশের ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সমান্তরাল বৈপরীত্যের রূপালি দলিল।

গণশত্রু ১৯৮৯ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তি পায়। কিন্তু সিনেমাটা আগাগোড়া কলকাতা কেন্দ্রিক। আরও বিস্তৃত করে বললে, এ গল্প আমাদের সবার- বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ আর কুসংস্কারে অন্ধ উপমহাদেশীয়দের। ইবসেনের নাটককে প্রায় অক্ষত রেখে একেবারে খাঁটি ভারতীয় উপমহাদেশের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন রায়।
সিনেমার গল্পের কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের ছোট শহর চ-ীপুর। এ শহরের একজন ডাক্তার হচ্ছেন অশোক গুপ্ত। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার ছিমছাম সংসার। রোগীদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি টের পান, চ-ীপুরে হঠাৎ করে জন্ডিসের প্রকোপ বেড়েছে। শহরের সবচেয়ে জনবহুল স্থান ভবানীপুরের পানি কলকাতা থেকে পরীক্ষা করিয়ে গুপ্ত টের পান, ঐ এলাকার পানীয় জলের উৎসগুলো জন্ডিস রোগের জীবাণুতে ভর্তি। ভবানীপুরে অবস্থিত, চ-ীপুরের গৌরবের প্রতীক ত্রিপুরেশ্বর মন্দিরের ভূ-অভ্যন্তরস্থ পাইপ লাইনে ফাটল ধরে এমন ঘটনা ঘটেছে। আর সেই মন্দিরের পানি সাধারণ মানুষ নিয়মিত পান করছে। এরকম চলতে থাকলে এলাকায় জন্ডিস মহামারী আকারে দেখা দেবে ভেবে ন্যায়নিষ্ঠ ডাক্তারের সামাজিক দায়িত্ববোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি চান, মন্দিরটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে জলাধার সংস্কার করা হোক।

কিন্তু, এ মন্দির যে শহরের ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের বাড়তি আয়ের এক নির্ঝঞ্ঝাট উৎস! তারা কেন চাইবে মন্দির বন্ধ হোক, এতে করে যে তাদের সাকার নারায়ণ বেচে নগদ নারায়ণ প্রাপ্তিতে ব্যাঘাত ঘটবে! ডাক্তার গুপ্ত বুঝতে পারলেন, চ-ীপুরকে বাঁচানোর এই মহৎ কাজে গুটিকয় মানুষ ছাড়া আর কেউই তার সাথে নেই। শহরের প্রগতিশীল মানুষেরা থেকে শুরূ করে তার আপন ভাই, সবাই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া। আর এখানেই ঘটে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ – ডাক্তার অশোক গুপ্তের দশা এমনই হয়, তিনি হয়ে ওঠেন তথাকথিত গণশত্রু।

গণশত্রুকে আগাগোড়া ট্র্যাজেডি বলা হয়তো যাবে না। কিন্তু সিনেমাটি পুরাদস্তুর ট্র্যাজেডি হতে পারতো। ইবসেনের নাটকে ট্র্যাজেডিতেই সমাপ্তি ঘটেছিল। একটা কথা আছে, ‘যার জন্য চুরি করি, সে-ই বলে চোর’। ডাক্তার অশোকের হয়েছে সেরকম অবস্থা। তিনি চেয়েছিলেন চ-ীপুরের মানুষগুলো ভালো থাকুক। তার জন্য তিনি শহরের রুই-কাতলাদের সাথে লাগতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই শহরবাসীই শেষ অব্দি তাকে দোষী সাব্যস্ত করে গণশত্রু বলে আখ্যায়িত করল। ইবসেন তার নাটক শেষ করেছেন এরকম একটা পরিস্থিতিতে। তার নাটকের প্রোটাগনিস্ট ডক্টর স্টকমানকে শেষ দৃশ্যে বলতে শোনা যায়, “পৃথিবীতে সেই লোকই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী যার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই, একদম কেউ।” ইচ্ছে করলে সত্যজিৎ স্টকমানের শেষ কথাটা রাখতে পারতেন তার সিনেমায়। তাতে হয়ত একটা বার্তা দর্শককে দেওয়া যেতে পারতো, কিন্তু তাহলে পুরো সিনেমায় সত্যজিতের স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু থাকত না। সেজন্য তিনি তার স্ক্রিপ্টে কিছুটা অদলবদল ঘটালেন। সমাপ্তিটা নিজের মতো করে টানলেন। ডাক্তার অশোক গুপ্ত যখন ব্যর্থ, পরাজিত, আর কোনো আশা দেখছেন না চ-ীপুরকে বাঁচানোর জন্য, এমনকি শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া তার সামনে আর তখন কোনো পথই খোলা নেই, তখনই তার কিছু কাছের মানুষ ও সমাজের কিছু প্রগতিশীল তরুণ-তরুণী তার সমর্থনে এগিয়ে আসে। একটা নতুন আশার আলো ফুটে ওঠে, আবার নতুন করে শুরু করার প্রেরণা পান ডাক্তার গুপ্ত। হয়তো সত্যজিৎ নিজেই এমন চেয়েছেন। অসুস্থ হয়ে অর্ধ দশকের মতো পড়ে থাকার পর আবারও সিনেমায় নেমেছিলেন তিনি। তাই হয়তো তিনি নিজেই আশার আলো দেখেছিলেন, ভেবেছিলেন আবারও ‘নতুন করে করব শুরু’। কিন্তু সে আর হলো কই! তিনটের বেশি সিনেমাতো আমাদের আর দিতে পারলেন না।

গণশত্রু আমাদের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এক সপাট চপেটাঘাত। রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা, অস্থির ও নিষ্ফলা রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও সমাজের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে সত্যজিৎ কিছুটা ক্ষুণœ ছিলেন। তার জীবনীকার অ্যান্ড্রু রবিনসন সত্যজিৎ রায় দ্য ইনার আই বইতে সত্যজিতের এই মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।

সত্যজিৎ ইচ্ছে করলেই ফিল্ম বানিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাতে পারতেন। তিনি ইচ্ছে করলে হলিউডে নাম লেখাতে পারতেন, কিন্তু অনেক অফার তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শুধু বাংলায় তার শেকড় বলে।

অনেকেই মনে করেন সত্যজিৎ গণশত্রুতে হরিদাস চরিত্রের মাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতার দিকে অঙুলি নির্দেশ করেছেন। শহরের প্রগতিশীল পত্রিকা বলে পরিচিত জনবার্তার সম্পাদক হরিদাসকে আমরা দেখি প্রথমদিকে ডাক্তার গুপ্তকে সমর্থন করতে। হরিদাসও চায়, তার শহরের দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দিতে। কিন্তু একটা সময় সেও পরাজিত হয় অসৎ শক্তির কাছে। ডাক্তার অশোকের তেজোদ্দীপ্ত লেখা ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করে। কিন্তু হরিদাসের এহেন আচরণ হলুদ সাংবাদিকতা, নাকি সেল্ফ সেন্সরশিপ, সেটাও ভাবার বিষয়। হরিদাস মনে মনে ডাক্তারের মেয়েকে ভালোবাসে। হরিদাস যদি রানুকে মনে মনে কামনা করে, তবে তাতে দোষের কী আছে? ভালোবাসা কি অপরাধ? আর ভালোবাসার মানুষকে দেখতে চাওয়াটাও কি অপরাধ? মোটেই নয়। কিন্তু হরিদাস যখন রানুর মন জয় করতে ব্যর্থ হয়, তখন সে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয় লেখাটা ছাপাবে না বলে।

তার এই অপ্রাপ্তি হয়তো ডাক্তার অশোকের ওপর থেকে তার সমর্থন তুলে নেয়, যা তার নৈতিক স্খলন। কিন্তু পাশাপাশি আরেকটা ব্যাপারও তাকে ভাবতে হয়। মফস্বলে একটা কাগজ চালাতে গেলে অনেক বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়- এটা হরিদাসের নিজের স্বীকারোক্তি। সুতরাং প্রভাবশালীদের কথায় কিছুটা সায় না দিয়ে একজন সম্পাদক হিসেবে তার পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব কাজ। এই ব্যাপারটা অনেকটা সেল্ফ সেন্সরশিপ তৈরি করে নেয়। ফলে অনেক সময় একটি আপাত প্রগতিশীল পত্রিকার পক্ষেও পুরোপুরি জনগণের পক্ষে হয়ে কথা বলাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটাই বাস্তবতা আর এই বাস্তবতাটাকেই সত্যজিৎ তুলে ধরেছেন। যদি এই অংশটুকু সিনেম্যাটিক করতে চাইতেন, তাহলে হয়তো আমরা হরিদাসকে সব বাধা সত্ত্বেও ডাক্তার অশোকের পক্ষে কলম ধরতে দেখতাম।

অনেক সমালোচকই গণশত্রুকে সত্যজিতের সবচেয়ে নিম্নমানের চলচ্চিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, হচ্ছে, এই সিনেমায় সত্যজিতের স্বভাবজাত নিগূঢ় আর্ট বা মন্তাজের খেলা নেই। আবার কিছু সহচরিত্রের অভিনয় খুব একটা মানসম্পন্ন ছিল না। এটা সত্য বৈকি, সিনেমায় লোকেশন আর প্রকৃতিকে নিয়ে উঁচু মাপের কাজ করতেন সত্যজিৎ। তার প্রতিটি দৃশ্যই দর্শককে কিছু না কিছু বার্তা দিত। আর লোকেশনের পারফেকশনের জন্য সারাজীবন তিনি কম দৌড়ঝাঁপ করেননি। পথের পাঁচালী, গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর জন্য যেমন বাংলা মুলুকের বন জঙ্গলে, গাঁওগেরামে ছুটে বেড়িয়েছেন, তেমনি সোনার কেল্লা বা হীরক রাজার দেশে বানানোর জন্য রাজস্থানের মরুভূমি চষে বেড়িয়েছেন। গুপী গাইন বাঘা বাইন ও হীরক রাজার দেশে বানানোর সময় সার্কাসের বাঘকে শুটিংয়ে রাজি করাতে তাকে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছিল। একেই বলে শুটিং বইয়ে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, সুতরাং সত্যজিতের একজন ভক্ত হিসেবে, তার সিনেমার অনুগত দর্শক হিসেবে যে কেউ গণশত্রু বা শেষ বয়সের বাকি দুটো ইনডোর সিনেমার সেট নিয়ে, ক্যামেরার কাজ নিয়ে অনুযোগ করতে পারে। এই সিনেমায় সত্যজিৎকে পুরোপুরি ক্যামেরার গৎবাঁধা ব্যাকরণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। কিছু ধরাবাঁধা ক্লোজআপ, মিডশটের ভেতরেই আটকে ছিল পুরো সিনেমা। ক্যামেরা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করেননি পরিচালক। এমনকি শেষ দৃশ্যে যখন ঘরের বাইরে ডাক্তার গুপ্তের সমর্থনে জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন প্রগতিশীল মানুষেরা, তখন শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডে মিছিলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মিছিল দেখানোর মতো বাড়তি ঝামেলায় যাননি পরিচালক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট