চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ফিরে দেখা বাংলা চলচ্চিত্র

দেশীয় চলচ্চিত্রে লোকজীবনের প্রভাব

বোরহান উদ্দিন

২ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:২০ পূর্বাহ্ণ

এদেশীয় চলচ্চিত্র জনজীবনেরই চিত্রায়ণ। চলচ্চিত্রে বিষয় হিসেবে বেছে নেয়া হয় মানুষের জীবন, জীবনযাত্রার ধরন ও জীবনেরই খ-চিত্র। এতে আধুনিক ও চলমান জীবনযাত্রা যেমন উঠে আসে তেমনি ঐতিহাসিক কিংবা কাল্পনিক কাহিনী নিয়েও নির্মিত হতে পারে উৎকৃষ্ট মানের চলচ্চিত্র। সেই জীবনে যেমন ব্যক্তিমানুষের যাপিত-জীবন, কর্মধারা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ, বিরহ-মিলন থাকে, তেমনি থাকে সামাজিক জীবনের একক হিসেবে পারিবারিক সমস্যা-সংকটের কথা। এমনকি ফ্যান্টাসি, লোককাহিনী বা ভৌতিক কল্পকাহিনী নিয়েও নির্মিত হতে পারে স্বার্থক চলচ্চিত্র। এদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তাতে কালানুক্রমিক বিবেচনার পাশাপশি বিষয়ভিত্তিক বিবেচনায় স্থান পেয়েছে সামাজিক, লোকছবি, যুদ্ধ, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার, কমেডি, ঐতিহাসিক ও শিশুতোষ চলচ্চিত্র।

এদেশীয় চলচ্চিত্রে লোকজীবনসংশ্লিষ্ট নানা উপাদানের বহুল ব্যবহার যেমন- লোকসঙ্গীত, লোকগাথা, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, রূপকাথা ও কিংবদন্তি, লোকউৎসব, লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কার, লোকাচার, লোকনাম ও লোকখেতাব প্রভৃতি। একারণে আমাদের চলচ্চিত্রে লোকজীবন-জিজ্ঞাসার গভীরতা ব্যাপক ও বিস্তৃত।

১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের ‘মুখ ও মুখোশ’ এ অঞ্চলের মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের পর বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় বিপুল উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়।

আমাদের দেশীয় লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ যাত্রাপালা। তেমন একটি কাহিনী ও গান ভিত্তিক যাত্রাপালা ‘রূপবান’। আটকুঁড়ে একাব্বর বাদশা, আটকুঁড়ে বাদশার মুখ দর্শনে রাজ্যের অমঙ্গল, রাজ্য ছেড়ে নির্বাসন, গভীর বনে সাধুর ধ্যান ভঙ্গ, বাদশাকে সাধুর অভিশাপ যার ফলে বাদশার ১২ দিনের ছেলে (রহিম বাদশা) কে উজিরের ১২ বছরের মেয়ের (রূপবান) সাথে বিবাহ দিয়ে বনবাসে পাঠানো, রহিমের সাথে ছায়েদ বাদশার মেয়ে তাজেলের পরিচয়। ঘটনাক্রমে রহিম ও রূপবান আবার রাজ্যে ফিরে আসা। ষাটের দশকে যাত্রাপালা হিসেবে ‘রূপবান’ পালাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। যাত্রাপালার চলচ্চিত্রে রূপদান করেন পরিচালক সালাহ্উদ্দিন। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় ‘রূপবান’। আবহমানকাল থেকে বাংলার সুপরিচিত এ কাহিনীটি সেলুলয়েডে দেখার জন্য ভিড় জমে প্রেক্ষাগৃহে। ছবিটির সংগীত পরিচালক সত্য সাহা রূপবানের যাত্রাপালা থেকে লোকজ আবহ অক্ষুণœ রেখে প্রচলিত গানগুলো ব্যবহার করেন। পুরো ছবিটি নির্মিত হয়েছিল যাত্রাপালার ঢঙে।

‘রূপবান’ লোককাহিনীর সাফল্যের পরের বছর ১৯৬৬ সালে লোককাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের যেন হিড়িক পড়ে, মুক্তি দেয়া হয় ১০টি লোককাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র। সালাহ্উদ্দিনের দেখাদেখি রূপবান নিয়ে পরের বছর চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় আরো দুটি-‘রহিম বাদশা ও রূপবান’ (১৯৬৬) ও ইবনে মিজানের ‘আবার বনবাসে রূপবান’ (১৯৬৬)। একই বছর মুক্তি পায় জহির রায়হানের লোককাহিনীনির্ভর ছবি ‘বেহুলা’ ও খান আতাউর রহমানের ‘রাজা সন্ন্যাসী’।

চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে বাংলার লোকজীবনে প্রচলিত লোককাহিনী, হিন্দু পুরাণ মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের উপাখ্যান অবলম্বনে। লখিন্দরের প্রতি বেহুলার প্রগাঢ় প্রেম কালে কালে আলোচিত হয়ে এসেছে। প্রাচীন বাংলার লোককথায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় বেহুলা-লখিন্দরের এই প্রেমকাহিনীকে।

এ ঘটনাটির অবলম্বনে জহির রায়হান নির্মাণ করেন বাংলা চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’। বেহুলা-লখিন্দরের এই প্রেমগাথা বাংলা লোকসংস্কৃতির এক অপূর্ব সম্পদ বলে সর্বমহলে গৃহীত। পরিচালক সফদর আলী ভূঁইয়া ১৯৬৭ সালে ‘ঝুমুর যাত্রা’র জনপ্রিয় পালা ‘কাঞ্চননমালা’র কাহিনী চলচ্চিত্রে রূপদান করেন। আজিজুর রহমান নির্মাণ করেন ‘ঝুমুর যাত্রা’র নন্দিত পালা ‘মধুমালা’ (১৯৬৮) এবং ইবনে মিজান নির্মাণ করেন ‘রাখালবন্ধু’। ‘রাখালবন্ধু’ কাহিনীতে লোকজ জীবন প্রতিফলিত। বিশেষত লোকসঙ্গীতের প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাহিনীকে লোকজীবনঘনিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। ‘রাখালবন্ধু’ চলচ্চিত্রটি ফোকফ্যান্টাসিতে পূর্ণ। কাহিনী শেক্সপিয়র থেকে নেয়া হলেও প্লট ও চরিত্র মিলিয়ে দেশীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র কাহিনীভিত্তিক ‘বেদের মেয়ে’ ও ‘মলুয়া’ চিত্রায়িত হয়। পরিচালক সালাহউদ্দিন ‘আলোমতি প্রেমকুমার’ যাত্রাপালার কাহিনীকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন। আলোমতি প্রেমকুমারের মূল উপজীব্য বিষয় মানব-মানবীর প্রেম। এতে উঠে এসেছে আলো ও প্রেম কুমারের ভালবাসার এক অনন্য নিদর্শন।

‘সাতভাই চম্পা’ (১৯৬৮) চলচ্চিত্রের কাহিনীতে লোকজীবনের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে। ‘সাতভাই চম্পা’ হলো বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় রূপকথার গল্প। ‘সাতভাই চম্পা’র গল্প অবলম্বনে বেশ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। এর কাহিনীতে রাণীদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে ছয় ছেলে ও এক মেয়ে ফিরে পাওয়ার কাহিনীর মধ্যদিয়ে সত্যের জয় ঘোষিত হয়েছে। ‘সাতভাই চম্পা’ চলচ্চিত্রটিকে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট সর্বকালের সেরা দশটি বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে স্থান দিয়েছে। লোককাহিনী এবং লোকগীতির সমন্বয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘কাজলরেখা’ (১৯৭৬)। কাহিনী হিসেবে এটি রূপকথার অন্তর্গত। এর গানের এবং লোকবিশ্বাস, দরবেশ-বাবার লোকপুরুষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে লোকচেতনা রয়েছে। কিন্তু পুরোটাই একটি ফ্যান্টাসি। ‘গুনাইবিবির পালা’র জনপ্রিয় কাহিনীর পুর্নবিন্যস্ত চিত্ররূপ। চিত্রায়ণের প্রয়োজনে মূলকাহিনীর কিছু বিচ্যুতি ঘটলেও তাতে প্রকৃত রস ও সুর নষ্ট হয়নি। গুনাই ও তোতার বাল্যপ্রেমের ওপর ভিত্তি করে এই কাহিনী গড়ে উঠেছে। এতে রূপায়িত প্রতিটি

দৃশ্যই লোকজীবন থেকে নেয়া। লোকগাথার রূপায়ণের কারণে ‘গুনাইবিবি’ (১৯৮৫) জনমনে আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে।

আমাদের দেশে বেদে সম্প্রদায় একটি জীবিকানির্ভর লোকসম্প্রদায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী ও নৌকাজীবন ও লোকজ জীবনের রূপক হয়ে উঠেছে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র (১৯৮৯) জনপ্রিয়তার পেছনেও হয়তো বাঙালি লোকজীবনের প্রতি দর্শকের ঐতিহ্যপ্রীতি ক্রিয়াশীল। সর্পবিশ্বাসও এই অঞ্চলের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বিষ নামানোর দৃশ্য এবং বেদেনৃত্য গ্রামীণ মানুষের আকর্ষণের বিষয়। সাপুড়ের গান এবং ‘বেদের মেয়ের জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’ গানের সুর ও শারীরিক কসরতও একশ্রেণীর মানুষকে প্রেক্ষাগৃহে টেনে নিয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্রটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বাধিক বাণিজ্যসফল সিনেমা।
অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমাংশে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়, তখন কাহিনীর মধ্যে সামাজিক, ধর্মীয় ও কল্পনাশ্রিত বিষয় যেমন প্রাধান্য পায়, তেমনি পৌরাণিক, লৌকিক ও অলৌকিক বিশ্বাসজাত বিষয়ও স্থান পায়। সাপও তাই বাংলা চলচ্চিত্রের সেই শুরুর কাল থেকেই এর একটি উপাদান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাগের পর পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রেও সাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে রয়ে গেছে।

এই পর্বে শুধু সাপ নয়, যারা সাপখেলা দেখায়, যারা সাপ ধরে ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে, তারাও চলচ্চিত্রের বিষয় হয়ে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পর্বের কয়েকটি চলচ্চিত্রের কথা স্মরণ হয় যেমন- ‘মহুয়া’ (১৯৬৬), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ (১৯৬৮), ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’ (১৯৬৯), ‘বেদের মেয়ে’ (১৯৬৯), ‘নাগিনীর প্রেম’ (১৯৬৯), ‘মলুয়া’ (১৯৬৯), ‘আমীর সওদাগর’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী’ (১৯৭০) প্রভৃতি। উল্লিখিত চলচ্চিত্রগুলো পর্যবেক্ষণের আওতায় আনলে দেখা যাবে, অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই সাপ যেমন একটি চরিত্র হয়ে এসেছে।

আগামীতেও এর বিকাশ অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু বর্তমানে চলচ্চিত্রশিল্পে ভিনদেশী চলচ্চিত্রের নকল করার প্রতিযোগিতা বড় দৃষ্টিকটু হয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় হতে পারে যে, যাত্রা বা লোককাহিনী আমাদের দেশ থেকে উর্দু চলচ্চিত্র হটিয়ে দিয়েছিল সেই লোকজীবন নির্ভর সুস্থ ও স্বকীয় ধারার পুননির্মাণ, গবেষণার মাধ্যমে জনমানসে লোককাহিনীর প্রভাব অনুসন্ধান এবং বৃহৎ পরিসরে চলচ্চিত্রে লোকজীবনের গভীরতায় জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাস নির্মাণে গুরুত্ব দেয়া।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট