চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

রাজনৈতিক সচেতনতা ও বাংলাদেশি চলচ্চিত্র

নাদির জুনাইদ

৪ মে, ২০১৯ | ২:০০ পূর্বাহ্ণ

চলচ্চিত্রকে শিল্পকলার একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও অনেকে মনে করেন, বিনোদন প্রদানই এর মূল কাজ; দর্শককে বিনোদনের মাধ্যমে আকৃষ্ট করতে না পারলে একটি চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রতিও দর্শক মনোযোগী হবে না। এমন ধারণার সঙ্গে যৌক্তিকভাবে দ্বিমত পোষণ করা যায়। বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র তৈরি হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সব চলচ্চিত্রেই যে বিনোদনধর্মী উপাদান থাকতে হবে এমন ধারণা অগ্রহণযোগ্য। দর্শককে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার জন্যও বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে। এই ধরনের চলচ্চিত্রে বর্তমান সময়ের জরুরি সমস্যাগুলির মূল কারণ তুলে ধরা হয়।
সত্যজিৎ রায়ের বহুল আলোচিত ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) ছবিটির কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও সত্তরের দশকে সেখানে মানুষ দেখতে পেয়েছে রাজনৈতিক পীড়ন আর জরুরি অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে নিজ ছবিতে সত্যজিৎ স্যাটায়ারের মাধ্যমে শাসকদের আচরণের অসঙ্গতি ও সমাজে টিকে থাকা অন্যায় তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এমন রাজনৈতিক সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল দর্শককে বর্তমান ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।
তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিকতা-পরবর্তী সমস্যা-পীড়িত পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের ছবিতে সমকালীন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। বর্তমানের গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা কখনও তাঁরা তুলে ধরেছেন সরাসরিভাবে (মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’); কখনও সমালোচনা করা হয়েছে রূপকের মাধ্যমে (জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’, আবদার রহমান সিসাকোর ‘বামাকো’)।
একটি রাষ্ট্রের বিদ্যমান ব্যবস্থা এই ধরনের ছবি সহজে গ্রহণ করবে না এমন ঝুঁকি নিয়েই সমাজসচেতন চলচ্চিত্রকাররা প্রতিবাদী ছবি তৈরি করেন। আমরা জানি, ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) নির্মাণের সময় জহির রায়হানকে বার বার পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসনের অসন্তোষ আর ক্রোধ মোকাবেলা করতে হয়েছিল। রূপকধর্মী কাহিনির মাধ্যমে পরিচালক শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা তুলে ধরেন। তা সত্ত্বেও সরকারি নির্দেশে ছবি থেকে বিভিন্ন দৃশ্য তাঁকে বাদ দিতে হয়।
তারেক মাসুদ যখন ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহারের সমালোচনা করে ‘মাটির ময়না’ (২০০২) নির্মাণ করেন, তখন এমন বিষয়বস্তু স্পর্শকাতর আখ্যা দিয়ে ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ছবিটতে পরিবর্তন আনতেও বলা হয় তারেককে। এরপর ছবিটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও সিনেমা হলগুলোতে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ঘটনাসমূহ নির্দেশ করে, সমাজের নেতিবাচক দিকের সমালোচনা চলচ্চিত্রে প্রকাশের কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন। তবে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, ওসমান সেমবেন, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ এবং বিভিন্ন দেশে আরও অনেক চলচ্চিত্রকার এমন ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করেছেন।
ষটের দশকে বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিবাদের ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল সেটি তুলে ধরার চেষ্টা তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। হয়তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তা করেই চলচ্চিত্রকাররা এতে অনাগ্রহী ছিলেন। তখন সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সাহসী সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছিল একমাত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতেই।
একটি গণযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন ছিল পুরনো উপনিবেশী সমাজকাঠামোর চিন্তাসমূহ প্রত্যাখ্যান করা। স্বাধীন সমাজে নতুন চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে চলচ্চিত্রও ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা জরুরি ছিল। যে অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র-ভাষা ব্যবহার এবং রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেও প্রায়ই সমকালীন সময় সরাসরি তুলে ধরা হয়নি। সেখানে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে পরোক্ষভাবে, অতীতের কোনো সময় তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। যেমন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করলেও আলমগীর কবিরের ‘রূপালী সৈকতে’ (১৯৭৯) ছবিটিতে কাহিনির সময়কাল ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৭০ এর বাংলাদেশ নয়। মসিহ্উদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ (১৯৮০) ছবির কাহিনির পটভূমি ভারতভাগের ঠিক আগে পূর্ব বাংলার এক গ্রামের জীবনযাত্রা।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রবণতাটির স্পষ্ট সমালোচনা উঠে এসেছে ‘মাটির ময়না’ ছবিতে। এটি যখন নির্মিত হয় তখন এই সমালোচনা প্রাসঙ্গিক হলেও ছবির কাহিনিতে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম ও মফস্বল শহরের পরিবেশ।
কেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সমসাময়িক জরুরি ও গুরুতর সমস্যাগুলির মুখোমুখি হওয়ার প্রচেষ্টা খুব কম চোখে পড়ে সেই প্রশ্ন বিশ্লেষণ করা দরকার। স্বাধীন বাংলাদেশেও দ্রুতই পুরনো পাকিস্তানি ব্যবস্থার মতো ফিরে এসেছিল সামরিক শাসন। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও সমাজে বিভিন্ন পুরনো সমস্যা টিকে থাকা নির্দেশ করে, নতুন সমাজেও মানুষের চিন্তার মুক্তি পরিপূর্ণভাবে ঘটেনি। রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা তাই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
সমকালীন পরিস্থিতির বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা এবং মানুষকে পীড়িত করছে এমন সমস্যার যৌক্তিক সমালোচনা চলচ্চিত্রে প্রকাশের চেষ্টায় সমর্থন দেবার পরিবেশ তৈরি না হলে সমাজ-সচেতন, বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র তৈরি হবে না। সেন্সরের কারণে রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া এবং সমকালীন সমস্যার সমালোচনা সম্ভব নয় এমন আশঙ্কা চিন্তাশীল ছবি নির্মাণে আগ্রহী চলচ্চিত্রকারদের কাজ বাধাগ্রস্ত করবে। রাজনীতিমনস্ক পরিচালকদের প্রতিবাদী ছবি তৈরির সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে আবারও উল্লেখ করা যায় পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রের কথা।
সত্তরের দশকের শুরুতে সেখানে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নকশালবাদী আন্দোলন চলার সময় মৃণাল সেন তাঁর কলকাতা ত্রয়ীর ছবিসমূহে সমাজ কাঠামোর তীব্র সমালোচনা তুলে ধরেছিলেন। নকশালপন্থী তরুণদের নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদও তিনি চলচ্চিত্রে প্রকাশ করেছিলেন। তখন নকশালপন্থী আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা হলেও মৃণাল সেনের রাজনৈতিক চলচ্চিত্রসমূহের সেন্সর ছাড়পত্র পেতে সমস্যা হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন সচেতন চলচ্চিত্রকার যৌক্তিকভাবে বক্তব্য ও প্রতিবাদ প্রকাশের সুযোগ পাবেন সেটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে চলচ্চিত্রকারদের জন্য এমন সুযোগ কি গত চার দশকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? চিন্তাশীল চলচ্চিত্র প্রয়োজনীয় বিবেচনা করে এই ধরনের ছবির প্রসারের জন্য চলচ্চিত্রকারদের কতটা উৎসাহিতই-বা করা হয়েছে? উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এ ধরনের ছবি আমাদের দেশে হয়তো নিয়মিত নির্মিত হত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট